যে কারণে বিএনপিতে ফিরতে পারছেন না বি. চৌধুরী ও অলি

দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরও বিএনপিতে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্মতির পরও ঝুলে আছে পুরনো নেতাদের ‘ঘরে’ ফেরা। অনেকে এটিকে রহস্যময় বলে আখ্যায়িত করছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বি. চৌধুরী এবং অলি আহমদসহ দল ও জোটের বৃহত্তর ঐক্যের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা এখন দুটি। একটি হলো— জামায়াতে ইসলামী, অপরটি বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের একজন ক্ষমতাধর কর্মকর্তা। যার কথায় এখন পুরো বিএনপি চলছে বলেও সারা দেশের নেতা-কর্মীদের মধ্যে জনশ্রুতি আছে।বিডি প্রতিদিন

পাশাপাশি দলের অযোগ্য ও ভয়ানক প্রতারক শ্রেণির কিছু নেতা দলে নিজেদের গুরুত্ব কমে যাওয়ার ভয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তারা যে করেই হোক বিএনপিতে বি. চৌধুরী ও কর্নেল অলির মতো পুরনো নেতাদের প্রবেশ রোধ করাসহ ড. কামালের গণফোরাম, আ স ম রবের জেএসডি আর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক লীগের মতো সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির বৃহত্তর ঐক্য গড়তেও নারাজ। উপরন্তু এ সম্পর্কে বেগম খালেদা জিয়ার কান ভারি করাসহ তার ভিতরে সবসময় সন্দেহ আর অবিশ্বাস জিইয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। দলের একটি অংশের নেতারা খালেদা জিয়াকে বুঝিয়েছেন, চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে প্রভাবশালী ওই দুই নেতা কী করেন, তার ঠিক নেই। তাদের নেতৃত্বে দল ভাঙতে পারে বলেও নেতিবাচক শঙ্কা ছড়ানো হচ্ছে। এমনকি এরসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের নাম জড়িয়েও কুৎসা রটানো হচ্ছে বিভিন্নভাবে।

ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়েও মাহী বি. চৌধুরীর সঙ্গে দলের দূরত্ব তৈরি করে গুলশান কার্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্যরা। খালেদা জিয়া মাহী বি. চৌধুরীকে মনোনয়ন প্রদানের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত আবদুল আউয়াল মিন্টুকে উত্তর সিটির মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আর আবদুল আউয়াল মিন্টু মনোনয়নপত্রে ভুল করার পর তার ছেলে তাবিথ আউয়ালকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়া হয় বিএনপি থেকে। সেই থেকে মাহী বি. চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু। এ ছাড়াও দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর কর্নেল অলিকেও দলে নিতে ঘোর আপত্তি গুলশান কার্যালয়ের সিন্ডিকেটের। কারণ অলি আহমদ আর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অ্যধ্যাপক বি. চৌধুরী দলে ফিরে এলে এসব সিন্ডিকেটভুক্ত নেতাদের গুরুত্ব কমে যাওয়ার ভয়েই মূলত তারা বাধা দিচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে দলের ভিত ও ঐক্য শক্তিশালী করার ব্যাপারে আশাবাদী বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার মতে, দলের ভিতরে তেমন কোনো বিরোধী কিংবা অন্তর্কোন্দল নেই। যেটুকু আছে সেটা হলো নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। আর একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলে এটুকু নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকাটাই স্বাভাবিক।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে নানা ধরনের সুযোগ হাতে পাওয়ার পরও কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না বিএনপি। বারবার সম্ভাবনার কাছ থেকে ফিরে আসছে। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক ইস্যু হাতে পাওয়ার পরও কাজে লাগাতে পারেনি। উপরন্তু ‘ঘরের শত্রু বিভীষণের মতো’ চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে জিম্মি করে রাখার চেষ্টা চলছে অনবরত। সবধরনের মিডিয়া ও দলীয় নেতা-কর্মীসহ সর্বস্তরের জনগণের কাছ থেকেই কৌশলে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে খালেদা জিয়াকে। দেশের ভিতরে দলটির পক্ষের মিডিয়া বলতে এখন শুধু দলীয় মুখপত্র ‘দৈনিক দিনকাল, দৈনিক নয়াদিগন্ত আর বন্ধ কাগজ দৈনিক আমার দেশ’ পত্রিকাকেই তুলে ধরা হয় খালেদা জিয়ার কাছে। পাশাপাশি অন্য সব মিডিয়াকে ‘সরকারের এজেন্ট’ বলে সমালোচনা করা হয় সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সামনে। স্বজনদের থেকে দূরে অবস্থানকারী বাড়িঘর ও সন্তানহারা ৭১ বছরের এই নেত্রীর বসবাস এখন কতিপয় কাজের লোক আর নিরাপত্তা সদস্যদের মাঝে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত এদের সঙ্গেই বসবাস তার। আর তার মধ্যেই রয়েছেন কতিপয় বিভীষণ। প্রকারান্তরে যারা দল ও জিয়া পরিবারের সঙ্গে দিনের পর দিন বিশ্বাসঘাতকতাই করে যাচ্ছেন এবং এদের বিশ্বস্ত মনে করে সরলমনে সেগুলোই গ্রহণ করছেন খালেদা জিয়া। এর ফলে ঘটনা যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। দিন দিন অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে দলটি। মামলা-হামলা আর জেল-জুলুমের খড়গসহ নানা ধরনের বিপদ ঘনিয়ে আসছে জিয়া পরিবারসহ সারা দেশে দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মীর সামনে। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অনেকেই এখন মামলার সাজা আতঙ্কে ভুগছেন। খোদ চেয়ারপারসনের মামলা নিয়েও রীতিমতো শঙ্কায় আছেন দলের নীতি-নির্ধারকরা। দলের সিনিয়র নেতাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রগুলো জানায়, দলের জন্য কাজ না করে মাঝখান থেকে ফায়দা লুটছেন চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় আর নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কতিপয় স্বার্থান্বেষী মধ্যস্বত্বভোগী ব্যক্তি। আর এতে জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর কতিপয় নেতা সহযোগিতা দিচ্ছেন বলেও জানান বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক। দলটির চেয়ারপারসনের চারপাশ ঘিরে আছেন এসব স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি। সারা দেশের লাখ লাখ নেতা-কর্মী গুলশান সিন্ডিকেটের এসব কর্মকর্তাকে দলের জন্যে ক্ষতিকর জানলেও একমাত্র বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘোর এখনো কাটেনি। বরং এদেরকেই তিনি বিশ্বস্ত বলে জানেন। বিএনপির ভুক্তভোগী নেতারা জানান, দলের ‘চেইন অব কমান্ড’ অনুসারে সাংগঠনিক কার্যক্রমও চলছে না। গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ তিন নেতা চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নির্দেশনা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না। যার ফলে বি. চোধুরী বা অলি আহমদের মতো নেতারা দলে ফিরতে পারছেন না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দলের বিরুদ্ধে যারা কাজ করছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় এসব অনিয়ম-দুর্নীতি যেমন অব্যাহত থাকবে তেমনি দলের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হতে থাকবে। স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, দলের চলমান সংকট কিছুটা দলের কারণে, আর বাকিটা দলের বাইরে সরকারের দমননীতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে। সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করতে হলে ‘যোগ্য’ লোকদের নেতৃত্বে এনে নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। দলে যার যে দায়িত্ব, তাকে তা করতে দিয়ে ‘চেইন অব কমান্ড’ ফিরিয়ে আনতে হবে। বিতর্কিত ব্যক্তিদের চেয়ারপারসন কার্যালয় ও নয়াপল্টন কার্যালয় থেকে সরিয়ে দিতে হবে। তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, দুদক ও আদালতের মাধ্যমে সরকার বিএনপিকে চাপে রাখতে চায়। সরকারের চাপকে আইনিভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করছেন তারা। বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, স্থায়ী কমিটিসহ অন্যান্য পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে দেরি হওয়ায় দলের ক্ষতি হচ্ছে। তাই এখন কারা এর নেপথ্যে, সেসব নিয়ে বাইরে নানা কথা ছড়ানো হচ্ছে। তিনি বলেন, এক-এগারো একবার হয়েছে বলে বারবার হবে এমন কোনো কথা নেই। তা ছাড়া ওই সময় ও এখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন সব দিক দেখেশুনে সতর্কতার সঙ্গে কমিটি দেবেন, এটিই সবার প্রত্যাশা। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, কোনো কারণে দলের কমিটি না দেওয়া হলে কিংবা কমিটি ঘোষণায় দীর্ঘসূত্রতা হলে বিএনপির ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হবে না।



মন্তব্য চালু নেই