যে কারণে বার বার হেরে যাচ্ছে বিএনপি

সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় রাজনৈতিকভাবে ঘরে বাইরে চাপের মুখে বিএনপি। একদিকে জাতীয় কাউন্সিলের ৩ মাস পরও পূর্ণাঙ্গ নির্বাহী কমিটি করতে না পারায় দলের ভেতরে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। অপরদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াতকে রাখা না রাখা নিয়েও দলের ভেতরে এবং বাইরে প্রবল চাপ রয়েছে। এসব চাপ সামাল দেয়ার কৌশল হিসেবে একেবারে নীরব থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি হাইকমান্ড।

সূত্র মতে, ৪ দফায় ৪২ জন নেতাকে নির্বাহী কমিটিতে স্থান দেয়ায় দলের পদ না পাওয়া নেতাদের মধ্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাগে ও ক্ষোভে অনেক নেতাদলীয় কর্মকা-ে অংশ নেয়া থেকে বিরত রয়েছেন। আর দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নতুন কমিটি গঠনের ব্যাপারেও রয়েছে প্রচ- চাপ। পদ প্রত্যাশী নেতারা পদবীর প্রতিযোগিতায় নেমে পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত হচ্ছে। আর দলীয় হাইকমান্ড এসব দেখেও না দেখার ভান করছে।

বার বার সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে দীর্ঘদিন পর জাঁকজমকভাবে জাতীয় কাউন্সিলের পর বিএনপি যখন পুনর্গঠনের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করার লক্ষ্য নিয়ে রাজপথে সক্রিয় হওয়ার চিন্তা করে ঠিক তখনই একের পর এক বৈরী পরিস্থিতির মুখে পড়ে। প্রথমত; অপেক্ষাকৃত সিনিয়র নেতাদের উপেক্ষা করে জুনিয়রদের বড় বড় পদ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে দলের মধ্যে অন্তঃকোন্দল চাঙ্গা হয়। নিজ দলের এক নেতা আরেক নেতার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে গিয়ে দলকেই বেকায়দায় ফেলেন।

সম্প্রতি বিএনপির নতুন কমিটিতে যুগ্ম মহাসচিবের পদ পাওয়া আসলাম চৌধুরী নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে দলকে ঘরে বাইরে চাপের মুখে ফেলেছেন। তিনি ভারত সফরে গিয়ে ইসরাইলী এক রাজনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ঘটনা নিয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কিন্তু এ পরিস্থিতি সামাল দিতে বিএনপির লন্ডন ও যুক্তরাষ্ট্র শাখার নেতারা বিভিন্নভাবে লবিং করে ওই ইসরাইলী রাজনীতিক মেন্দি এন সাফাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা সাফাদীকে দিয়ে বলান প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গেও তার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সাফাদীর সঙ্গে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বৈঠকের বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় ঘরে বাইরে সমালোনার মুখে পড়ে বিএনপি।

এদিকে দলের নির্বাহী কমিটি গঠন ও ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কিছু বিএনপি নেতার বিরোধ সৃষ্টি হয়। এসব কারণে সম্প্রতি বিএনপি রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। দলের কিছু সিনিয়র নেতা এ বিষয়ে চেয়ারপার্সনের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করলেও এতে কাজ না হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ হন।

১৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের কর্ম অধিবেশনে খালেদা জিয়াকে চেয়ারপার্সন ও তাঁর লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমানকে পুনরায় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। আর ৩০ মার্চ আগের কমিটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব, রুহুল কবির রিজভীকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মিজানুর রহমান সিনহাকে পুনরায় কাষাধ্যক্ষ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।

৯ এপ্রিল ঘোষণা করা হয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির ১৬ নেতার নাম। এর মধ্যে ৭ জন যুগ্ম মহাসচিব ও ৯ জন সাংগঠনিক সম্পাদক। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া ৭ জন যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে রয়েছেন আগের কমিটির একই পদে থাকা ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, আগের কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবুর রহমান সারোয়ার, আগের কমিটির যুববিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আগের কমিটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক জিএস খায়রুল কবির খোকন, আগের কমিটির স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, আগের কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হারুনুর রশিদ ও আগের কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক লায়ন আসলাম চৌধুরী।

ঘোষিত বিএনপির ৯ সাংগঠনিক সম্পাদকরা হলেন আগের কমিটির একই পদে থাকা ফজলুল হক মিলন (ঢাকা বিভাগ) ও আসাদুল হাবিব দুলু (রংপুর বিভাগ) রয়েছেন। বাকি ৭ জন নতুন সাংগঠনিক সম্পাদক হলেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডাঃ শাহাদাৎ হোসেন (চট্টগ্রাম বিভাগ), আগের কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু (খুলনা বিভাগ), আগের কমিটির স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু (রাজশাহী বিভাগ), আগের কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক ইমরান সাহেল পিন্স (ময়মনসিংহ বিভাগ), আগের কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ডাঃ সাখাওয়াত হোসেন জীবন, আগের কমিটির নির্বাহী সদস্য শ্যামা ওবায়েদ ( প্রস্তাবিত ফরিদপুর বিভাগ) ও আগের কমিটির নির্বাহী সদস্য বিলকিস জাহান শিরিন (বরিশাল বিভাগ)।

সর্বশেষ ১৮ এপ্রিল ঘোষিত তালিকায় স্থান পান আরও ২১ নেতা। এদের মধ্যে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে স্থান পান সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব) আনোয়ারুল আজিম (প্রস্তাবিত কুমিল্লা বিভাগ)। আর বাকি ২০ জন হলেন সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। ২০ সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরা হলেন ঢাকা বিভাগে আবদুস সালাম আজাদ ও শহীদুল ইসলাম বাবুল, চট্টগ্রাম বিভাগে মাহাবুবুর রহমান শামীম ও আবুল হাশেম বকর, রাজশাহী বিভাগে আবদুল মোমিন তালুকদার খোকা ও শাহীন শওকত, খুলনা বিভাগে অনিন্দ ইসলাম অমিত ও জয়ন্ত কুন্ড, বরিশাল বিভাগে আখন্দ কুদ্দুস ও মাহবুবুল হক নান্নু, সিলেট বিভাগে দিলদার হোসেন সেলিম ও কলিম উদ্দিন মিলন, রংপুর বিভাগে শামসুজ্জামান ও সৈয়দ জাহাঙ্গীর হোসেন, প্রস্তাবিত কুমিল্লা বিভাগে মোশতাক মিয়া ও আবদুল আউয়াল খান, ময়মনসিংহ বিভাগে শরীফুল আলম ও ওয়ারেস আলী মামুন, প্রস্তাবিত ফরিদপুর বিভাগে আলী নেয়াজ মাহমুদ খৈয়াম ও সেলিমুজ্জামান সেলিম।

বিএনপির নতুন কমিটিতে এখনও যাদের স্থান হয়নি এমন কেন্দ্রীয় নেতারা এখন দলীয় হাইকমান্ডের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত। তাই দলীয় কর্মকা-ে নামকাওয়াস্তে যোগ দিলেও তেমন আগ্রহ নিয়ে কাজ করছেন না। উপরন্তু একে অপরের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত এবং নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাসের বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া দলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। এর মধ্যে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় যে কোন সময় চূড়ান্ত রায় হয়ে যেতে পারে। তাই এসব মামলার কারণেও নেতারা রয়েছেন চাপে।

এদিকে ২০ দলীয় জোটে বিএনপির শরিক দল জামায়াতকে নিয়ে আগে থেকেই ঘরে বাইরে চাপ ছিল। কিন্তু ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় কিছুতেই জামায়াত ছাড়ছে না বিএনপি। সম্প্রতি নতুন করে জামায়াতকে নিয়ে চাপে পড়েছে বিএনপি। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশে অস্থিরতার জন্য জামায়াতকে দায়ী করে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার কোন আশ্বাস এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দেয়া হয়নি। তাই এ নিয়ে বিএনপি চাপে রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দলের ভেতরে এবং বাইরের চাপ থাকতেই পারে। তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে চাপ অতিক্রম করা সম্বব হয়। বিএনপি একটি অনেক বড় রাজনৈতিক দল তাই চাপ মোকাবেলা করেই এ দলকে এগিয়ে যেতে হবে।জনকণ্ঠ



মন্তব্য চালু নেই