যে কারণে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তান

ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেনান্ট জেনারেল জেএফআর জেকব৷ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা কুর্নিশ দাবি করে৷ আত্মসমর্পণ চুক্তিতে সই করতে গড়িমসি করায় জেনারেল নিয়াজির মাথায় বন্দুক ধরেছিলেন জেকব৷

পুরো নাম জেকব ফার্জ রাফায়েল, সংক্ষেপে জেএফআর জেকব৷ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যিনি পরিচিত ছিলেন লেফটেনান্ট জেনারেল জেকব নামে৷ বংশপরিচয়ের সূত্রে ইরাকি ইহুদি, কিন্তু তার পরিবার ইরাকের বাগদাদ থেকে চলে এসেছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায়৷ এই শহরেই ১৯২৪ সালে তার জন্ম৷ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর লড়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে৷ তার পর স্বাধীন ভারতের সেনানী হিসেবে ১৯৬৫ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে৷ কিন্তু লেফটেনান্ট জেনারেল জেকবের নাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা আছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকার জন্য৷

তখন তিনি মেজর জেনারেল, ভারতীয় সেনার পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তরের সেনাপ্রধানের পদে৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে এগিয়ে গেছে ভারতীয় সেনা৷ সেই বাহিনীর নেতৃত্বে জেনারেল জেকব৷ তারপর ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সেই ঐতিহাসিক বিজয়ের দিন৷ বিশ্বের ইতিহাসে জায়গা পেয়ে গেল স্থিরচিত্রটি৷ নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান এএকে নিয়াজি৷

ভারতীয় বাহিনীর লেফটেনান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা-র সামনে বসে সই করছেন অস্ত্র সমর্পণ এবং পরাজয় স্বীকারের চুক্তিপত্রে৷ ওঁদের দু’‌জনের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন ভারতীয় নৌ-বাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান, বিমান বাহিনীর এয়ার মার্শাল দেওয়ান, স্থলসেনার লেফটেনান্ট জেনারেল সগত সিং এবং মেজর জেনারেল জেকব৷

শুধু যে ভারতীয় সেনার পূর্বাঞ্চলীয় শাখার প্রধান হিসেবেই জেনারেল জেকব ঐ ঐতিহাসিক মুহূর্তে হাজির ছিলেন, তা নয়৷ এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে দখলদার পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলেও নয়, জেনারেল জেকবের আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পাকিস্তানের ওই আত্মসমর্পণে৷ যদিও পুরোটাই জনশ্রুতি, এবং যে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যেমন কিছু কল্পগাথাও জন্ম নেয়, হতেই পারে এটাও তেমনই এক উপকথা৷

শোনা যায়, যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পরেও আত্মসমর্পণ করতে রাজি ছিলেন না পাক সেনানায়ক জেনারেল নিয়াজি৷ তার আত্মসম্মানে লাগছিল৷ তখন এই জেনারেল জেকব ফাঁকা ঘরে নিয়াজির মুখোমুখি হন৷ কোমরের খাপ থেকে নিজের বন্দুক বের করে নিয়াজির মাথায় ঠেকিয়ে বলেন, অকারণ কথা নষ্ট হচ্ছে৷ হয় আপনি আত্মসমর্পণের চুক্তিতে সই করুন অথবা একটি গুলিতে এই ঝামেলা এখানেই শেষ করে দেব!‌ এর পর নিয়াজি নাকি আর কথা বাড়াননি, চুপচাপ সই করে দিয়েছিলেন৷

২০১১ সালে, কলকাতায় ভারতীয় সেনার পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর ফোর্ট উইলিয়ামে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের ৪০ বছর পূর্তির দিনটি মহা সমারোহে পালিত হয়েছিল৷ বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে আমন্ত্রিত ছিলেন সেই উদযাপনে৷ এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন লেফটেনান্ট জেনারেল জেকব৷ তখন তিনি যথেষ্ট বৃদ্ধ৷ লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন৷ কিন্তু তাও নজরে পড়ার মতো ব্যাপার ছিল, সভার জায়গায় পৌঁছে তিনি উপস্থিত সমস্ত সেনাকর্মীর সঙ্গে কথা বললেন, কুশল জানতে চাইলেন৷ যে সৌজন্য এবং সামরিক সৌভ্রাতৃত্ববোধ দ্বিতীয় কোনো সেনাকর্তা কিন্তু সেদিন দেখাননি৷ লেফটেনান্ট জেনারেল জেকবকে দেখে প্রশ্নটা না করে থাকতে পারিনি, যে আপনি সত্যিই জেনারেল নিয়াজির মাথায় বন্দুক ধরেছিলেন?‌

নির্ভিক সেনাপতির রসবোধেরও পরিচয় পেয়েছিলাম সেদিন৷ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‌সব বাজে কথা!‌ একদম কান দিও না এ সব গালগল্পে৷” তারপর রহস্য করার ঢঙে বলেছিলেন, ‘‌লড়াইয়ের ময়দানে ওরকম অপদস্থ হয়েও লোকটার লজ্জা হয়নি৷ বেঁকে বসেছিল, সই করবে না৷ তাই ভালো কথায় বোঝাতে হয়েছিল৷ ভালোভাবে বললে সবাই কথা শোনে৷ নিয়াজিও শুনেছিল৷” বলেই হা হা করে হেসে উঠেছিলেন ভারতের প্রবীণ এই সেনানায়ক৷

এই বছরের জানুয়ারিতে দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন লেফটেনান্ট জেনারেল জেকব, ৯২ বছর বয়েসে৷ – ডয়েস ভেলে



মন্তব্য চালু নেই