যেভাবে সন্তানকে বিদায় দিলেন খালেদা

পার্থিব জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে অবশেষে প্রিয় সন্তানকে শেষ বিদায় দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

না ফেরার দেশে চলে গেছেন কোকো, আর কখনও দেখতে পাবেন না প্রিয় সন্তানের মুখ। তাই ছেলের নিথর মুখ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কিন্তু বাস্তবতা মেনে নিতেই হয়। খালেদা জিয়াও সে সত্যের মুখোমুখি হয়ে বিদায় জানিয়েছেন ছেলেকে।

মঙ্গলবার গুলশানের কার্যালয়ে বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে আরাফাত রহমান কোকোর কফিন বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স আনা হয়। এরপর অ্যাম্বুলেন্স থেকে কফিন নামিয়ে কার্যালয়ের নিচ তলায় রাখা হয়। ভেতরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও নেতাকর্মীদের ভিড়ের চাপে কার্যালয়ের সামনে ফটকের পাশে গ্লাস ভেঙে যায়।

এর তিন মিনিট পর শুধু নিকটআত্মীয়দের দেখার সুযোগ করে দিতে কার্যালয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় কোকোর মরদেহ। কার্যালয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক কোকোর মরদেহ রাখা হয়।

কোকোর মরদেহ কার্যালয়ের ভেতরে আনার প্রায় ১০ মিনিট পর দোতলা থেকে বেগম জিয়াকে হাতে ধরে নিয়ে আনা হয় নিচ তলায়। ক্রিম কালারের সুতি শাড়ি পড়া বেগম জিয়া সিড়ি দিয়ে নামার সময়ে তার ছোট দুই ভাইয়ের স্ত্রী ও কোকোর স্ত্রী শামিলা রহমান সিথি ছিলেন।

কক্ষে খালেদা জিয়ার প্রবেশের পর অনেকে নিজেদের আর সামলে রাখতে পারেননি। কেঁদে ফেলেন তারা। আর দুই নাতনীর সঙ্গে দাদীর কান্না যেন একাকার হয়ে যায়। একে অন্যকে জড়িয়ে কেঁদেছেন অঝোর ধারায়।

খালেদা জিয়া যখন মরদেহের সামনে আসেন এরপরের দৃশ্যপট আরো বেদনাবিধুর। ছেলের কফিনের সামনে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কখনো বাকরুদ্ধ, কখনও কান্না আবার কখনো নাতনীকে জড়িয়ে শিশুর মতো কেঁদেছেন।

প্রায় সময় টিস্যু দিয়ে চোখ মুছছিলেন তিনি। কফিনে সাদা পোষাকে শুয়ে রাখা হয়েছে কোকোকে। মুখে দাঁড়ি। মা যখনই ছেলের দিকে তাঁকাচ্ছিলেন তখনই কাঁদছিলেন শিশুর মতো।

খালেদা জিয়ার পাশে তার ছোট দুই ভাইয়ের স্ত্রী, কোকোর স্ত্রী শামিলা রহমান সিথি, দুই মেয়ে জাফিয়া ও জাহিয়া ছিলেন। নিচ তলায় পরিবার পরিজনের বাইরে কাউকে যেতে দেয়া হয়নি। পারিবারিকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন চলে অনেকক্ষন।

কফিনের পাশে বসে দুই হাত তুলে ছেলের জন্য অশ্রুসজল চোখে মোনাজাত করেন খালেদা জিয়া। পাশের কক্ষে পবিত্র কোরান তেলাওয়াত চলছিলো।

এ সময় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের মা সৈয়দা ইকবালমান্দ বানুসহ তাদের আত্বীয়স্বজন ছাড়াও সেনা, বিমান ও নৌ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালু, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারি রহমান শিমুল বিশ্বাস, মাহবুব আলম ডিউ প্রমুখ সেখানে ছিলেন।

বাকরুদ্ধ খালেদা জিয়া প্রায় ৩৫ মিনিট কোকোর কফিনের পাশেই বসা ছিলেন। প্রায় ঘন্টাখানের শোকে স্তব্ধ থাকার পর খালেদা জিয়ার সামনেই কফিনটি ঢেকে দেওয়া হয়। কান্নার মধ্যেই দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেকে বিদায় দিলেন অজানার দেশে।

একদিকে লাশের কফিন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছিল আর অন্যদিকে খালেদা জিয়াকে ধরে নিয়ে দোতলায় তুলেছেন তার দুই ভাইয়ের বউ। এ সময়ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন তিনি।

গুলশানের কার্যালয় থেকে লাশ সরাসরি আনা হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। সেখানে বাদ আসর কোকোর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। সেখাকে তাকে সমাহিত করা হবে।

১৯৭০ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিলো, ঠিক ওই সময়ে কুমিল্লা সেনা নিবাসে আরাফাত রহমান কোকোর জন্ম। ছোট বলে মায়ের কাছে সবচেয় প্রিয় ছিলো কোকো। যেকোনো আবদার তার নিমিষেই পুরণ করতে হতো। আজ সেই প্রিয় পুত্রকে হারিয়ে খালেদা জিয়া যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।

গত শনিবার বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মালেয়শিয়ায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ মারা যান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কনিষ্ঠ পূত্র আরাফাত রহমান কোকো।

তার মৃত্যুতে দেশব্যাপী সোমবার থেকে তিনদিনের শোক দিবস পালন করছে বিএনপি। এ উপলক্ষে দেশের সব দলীয় কার্যালয়ে সোমবার থেকেই কালো পতাকা উত্তোলন ও নেতা-কর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করেছেন।

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সেনানিবাসের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে গ্রেফতার হন কোকো। ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরদিন চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যান তিনি। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী শর্মিলা রহমান, দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমান।

থাইল্যান্ড যাওয়ার পর মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় সেখান থেকে মালয়েশিয়ায় চলে যান কোকো। সেখানেই গত শনিবার তার মৃত্যু হয়।



মন্তব্য চালু নেই