মোবাইলের সঠিক ব্যবহার ও জরুরি মাসায়েল

আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক নব আবিস্কার হলো মোবাইল ফোন। বাদশাহ ফকির, নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, শিশু-কিশোর সকলের হাতেই এখন মোবাইল। কেমন যেন, মোবাইল ফোনটি আজকাল জীবনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর মানুষের জীবনকে করেছে গতিময়। আগের যামানায় যে কাজে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হত, বর্তমানে তা মুহূর্তের মধ্যে হয়ে যায়। এদিকে লক্ষ করলে বুঝে আসে মোবাইল অত্যন্ত জরুরি একটি জিনিস। কিন্তু একথা সত্য যে, মোবাইল ফোনের ব্যবহার কারো কারো জন্য অভিশাপের কারণ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এর শিকার। অনেকের মোবাইল তো অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় ভরপুর।

শুধু মোবাইলই নয়, রেডিও, টেপরেকর্ড, অডিও, ভিডিও, ক্যামেরা, টেলিভিশন এবং ইন্টারনেটের সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে মহামূল্যবান সময় নষ্ট করছে কত মানুষ। ভিডিও ফিল্ম দেখে, চলতে ফিরতে গান শুনে ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি দেখে নিজের চারিত্রকে ধ্বংস করছে। মোবাইল ফোন একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষার উজ্জ্বল আলো থেকে বঞ্চিত করে মূর্খতার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত করছে। ধ্বংস করে দিচ্ছে তার মহামূল্যবান জীবন সম্পদ কে। তাছাড়া যারা প্রয়োজনে মোবাইল ব্যবহার করে তাদের কেউ কেউ কিছু জিনিসের ক্ষেত্রে শরয়ী সীমা-রেখাকে স্থির রাখেনা এবং তাদের দ্বারা কী ভুল ভ্রান্তি হয় তাও বুঝে না।

মোবাইল ফোনের এসব ভয়াবহ ক্ষতি খারাবের প্রতি ইঙ্গিত, জনসাধারণের নিকট মোবাইল সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান ও মাসআলা-মাসায়েল উপস্থাপন করাই হলো এ লিখনির মূল উদ্দশ্য। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন। প্রিয় পাঠক! আল্লাহ তাআলার মনোনীত ধর্ম একমাত্র ইসলাম। আর কেয়ামত পর্যন্ত যাবতীয় সমস্যার শরয়ী সমাধান একমাত্র ইসলাম ধর্মেই পাওয়া যায়। আধুনিক সকল মাসআলা-মাসায়েলের সমাধান দিতে ইসলাম সম্পূর্ণ সক্ষম। আর বিজ্ঞানের একটি নব আবিস্কার হলো মোবাইল ফোন, যার সাথে শরিয়তের অনেক মাসআলা মাসায়েলের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সে মাসআলাগুলো মোবাইল ব্যবহারকারী প্রতিটি মুসলিম ভাইদের জানা অত্যন্ত জরুরি। যাতে এ সমস্ত মাসআলা মাসায়েল জেনে মোবাইলের ভয়াবহ ক্ষতি ও অপব্যবহার থেকে বাঁচতে পারে এবং শরিয়াতের অন্যতম উসুল ‘‘যতটুকু দ্বারা প্রয়োজন পূরণ হয় ততটুকু করা” এর উপর আমল করে মোবাইলের সঠিক ব্যবহার জানতে পারে।

মাওলানা মানসুরপুরী সাহেব মোবাইলের ব্যবহার নীতির উপর মূল্যবান ছোট্ট একটি রেসালা উর্দু ভাষায় রচনা করেছেন, যার অনুবাদ করেছেন ইবরাহিম খলীল সাহেব, এতে মোটামুটি মোবাইলের জরুরি মাসআলাগুলো লেখা হয়েছে। সেখান থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে তুলে ধরা হলো-

নামাজের মধ্যে মোবাইল ফোন বন্ধ করা নামাজ শুরু করার পূর্বেই মোবাইলের রিংটোনটি বন্ধ করে নেয়া আবশ্যক। এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে অভ্যাসে পরিণত করা চাই। তবে যদি ভুলবশত বন্ধ না করে নামাজ শুরু করে আর নামাজে তা বেজে উঠে, তখন মোবাইলটি পকেটে রেখেই এক হাত দিয়ে বন্ধ করবে। এর দ্বারা নামাজে কোন রকমের সমস্যা হবে না। আর মোবাইল বন্ধ করার জন্য নামাজ ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজন নাই। [বাহরুর রায়েক : ২/১১] নামাজে বারবার মোবাইল বাজা যদি একবার বন্ধ করার পর (অর্থাৎ একবার পকেটে হাত দিয়ে কল কেটে দেয়ার পর) যদি আবার বেজে উঠে, তাহলে আমলে কালিলের মাধ্যমে তিনবার পর্যন্ত কল বন্ধ করা যেতে পারে। তবে শর্ত হলো- এ বন্ধ করাটা যাতে আমলে কাছিরের সীমা পর্যন্ত গিয়ে না পৌঁছে।

যদি আমলে কাছির হয়ে যায়, তাহলে নামাজ ভেঙ্গে যাবে। [মাজমাউল আনহার : ১/১২] আমলে কালিল ও আমলে কাছির নামাজে আমলে কালিল ও আমলে কাছির নির্ধারণের ব্যাপারে ফোকাহায়ে কেরামের বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়। তন্মধ্যে গ্রহণযোগ্য মত হলো আমলে কাছির বলা হয়- নামাজে এমন কোন কাজ করা যার দ্বারা নামাজ বিশুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। অযথা এমন কোন কাজ করা, যা দেখে সামাজের বাহিরের লোকদের প্রবল ধারণা হয় যে, লোকটি নামাজে নেই। তবে যদি মুসল্লির কাজটি এ পর্যায়ের না হয়। তাহলে তাকে আমলে কালিল বলা হয়। [শামী : ১/৪৩] মোবাইল বন্ধ করার জন্য নামাজ ভেঙ্গে ফেলা যদি আমলে কালিলের মাধ্যমে মোবাইল বন্ধ করা সম্ভব না হয়, আর তা বাজতে থাকার কারণে নিজের ও অন্যান্য মুসল্লিদের নামাজে সমস্যা হয়, তাহলে শুধু একারণে নামাজ ছেড়ে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করা জায়েয নেই। কারণ নামাজ ছেড়ে দেয়ার অনুমতি শুধু বিশেষ কিছু ওযরের কারনে হয়ে থাকে। আর নামাজে একাগ্রতায় সমস্যা হওয়া এমন কোন শরয়ী ওযর নয়, যার কারনে নামাজ ছেড়ে দেয়ার অবকাশ রয়েছে। [শামী : ১/৪৪] রিংটোন হিসেবে আযান বা কুরআনের আয়াত সেভ করা রিংটোন দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করা যে, কোন ব্যক্তি আপনার সাথে আলাপ করার আশা করছে। বিষয়টি কেমন যেন দরজায় আওয়াজ করার মত।

সুতরাং এজন্য কুরআনের আয়াত অথবা আযানের আওয়াজকে ব্যবহার করার কোন যৌক্তিকতা নেই, বরং এক হিসেবে এর দ্বারা কালামে পাক ও আযানের মান ক্ষুন্ন হয়। তাই এর ভিত্তিতে ফোকাহায়ে কেরাম এ ধরণের উদ্দেশ্য হাসিলের ক্ষেত্রে যিকিরের শব্দগুলো ব্যবহার করাও না জায়েয বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং ফোকাহায়ে কেরামের ঘোষণা অনুযায়ী মোবাইলে রিংটোন হিসেবে আযান, কুরআনে কারিমের আয়াত ও হামদ-নাম ইত্যাদি সেভ করা ঠিক হবে না। অনেক সময় এমনও হয়ে থাকে যে, কেউ মোবাইল নিয়ে টয়লেটে প্রবেশ করলো, আর সেখানে আয়াতে কারিমার আওয়াজ ভেসে উঠলো এতে কুরআনের অবমাননা হয়। তাই এর থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। [হিন্দিয়া : ৫/৩১৬, আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ের : ৫৩, ইমদাদুল ফাতওয়া : ৩৪৯] রিংটোন হিসেবে গান সেভ করা মোবাইলের রিংটোনে গান বাজানো এবং মিউজিক লাগানো কখনই জায়েয নয় বরং মহাপাপ। [আত তারগিব ওয়াত তারহিব : ৪/১৮৪, শামী জাকারিয়া : ৯/৫৬৬] গান শোনা কোন অস্থাতেই গান শোনা জায়েয নেই চাই মোবাইলের মাধ্যমে হোক কিংবা অন্য কোন মাধ্যমে হোক। [কুরতুবি : ৭/৫০, শামী জাকারিয়া : ৯/৫৬৬] মোবাইলে ফিল্ম দেখা ফিল্ম দেখা সর্বাবস্থায় নাজায়েয হারাম।

চাই মোবাইলে দেখুক কিংবা অন্য কোথাও দেখুক। মোবাইলে ক্রিকেট ম্যাচ দেখা মোবাইল ইত্যাদির মাধ্যমে ক্রিকেট ম্যাচ দেখা অনর্থক সময় অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেক সময় তাতে গুনাহ অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কারণ খেলার মাঝে মাঝে এমন কিছু অশ্লীল ছবি ও এডভেটাইজ দেখানো হয়, যা দেখার দ্বারা দৃষ্টির হেফাজত সম্ভব হয় না। [ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৪/২৫৭, ফাতাওয়া রাহমানিয়া : ১০/৩২৬] মোবাইলে গেমস খেলা মোবাইলে গেমস খেলা মানে নিজের অমূল্য সম্পদ সময়কে অপচয় করা। তাই তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। [শুয়াবুল ঈমান : হা. ৪৯৮৭] মোবাইলের মাধ্যমে দ্বীনী বয়ান শোনা মোবাইলের মাধ্যমে দ্বীনী বয়ান হামদ-নাত ইত্যাদি শোনা জায়েয। তবে শর্ত হলো তাতে কোন ছবি না থাকা। [ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৫/২৪৯, কিফায়াতুল মুফতি : ৯/২০৭] মোবাইলে মিস্ডকল দেয়া মিস্ডকল করার ক্ষেত্রে একটু ব্যাখ্য রয়েছে, যদি এমন ব্যক্তিকে মিস্ডকল করা হয় যার সাথে তার অন্তরঙ্গতা রয়েছে কিংবা মিস্ডকল দিলে খারাপ মনে করবে না; বরং তার সাথে কল মিলাবে, তাহলে এমন ব্যক্তিকে মিস্ডকল দিতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু যদি কোন অপরিচিত লোক হয়, অথবা এমন কোন লোক হয় যাকে মিস্ডকল দিলে খারাপ মনে করবে, তাহলে এমন লোককে মিস্ডকল দেয়া ঠিক হবে না। [রুহুল মায়ানি : ১০/৩২৩] বিরক্ত করা মোবাইলে রিং দিয়ে কাউকে বিরক্ত করা বা কষ্ট দেয়া মস্পূর্ণ না জায়েয। [বুখারি]



মন্তব্য চালু নেই