মেসির চোখে জল

এমন নয় আগে তার চোখে জল দেখেনি ফুটবল বিশ্ব। আর্জেন্টিনার জার্সিতে বিশ্বকাপ আর কোপা আমেরিকার ফাইনালে হারার পর টলটলে চোখ থেকে দুগাল বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রুর কথা কখনো ভুলতে পারবেন না লিওনেল মেসি আর তার ভক্তরা। ফুটবলের ইতিহাসেরই বেদনাতুর দৃশ্যগুলোর মাঝে জায়গা করে নেবে মেসির সেই ছবিগুলো। বুধবার রাতে আরেকবার তেমন দৃশ্যের দেখা মিলল। তবে বেদনা ভারাক্রান্ত নয়, মেসির চোখে বেয়ে জল নেমে এলো বোঝা নেমে যাওয়ার, তীব্র সমালোচনার জবাব দেওয়ার। এই জলের নাম আনন্দঅশ্রু।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বুধবার রাতে শেষ ষোলোর দ্বিতীয় লেগে শেষমুহুর্তের ম্যাজিকে পিএসজিকে ৬-১ গোলে উড়িয়ে সেরা আটে পা রেখেছে বার্সেলোনা। প্রথম লেগে পিএসজির মাঠে ৪-০ গোলে হেরে আসা দলটি ন্যু ক্যাম্পে ঘুরে দাঁড়াল। কাতালানরা এদিন সত্যিকার অর্থেই ইতিহাস গড়েছে। নক আউটে প্রথম লেগে এত গোলে পিছিয়ে পড়ে আর কেউই ফিরে আসতে পারেনি আগে। কিন্তু দুই লেগ মিলিয়ে ৬-৫ গোলে কোয়ার্টারে এখন মেসি-নেইমাররাই।

ম্যাচ শেষে রোমাঞ্চ আর অবিশ্বাস্য সমাপ্তির উদযাপনে পাগলপারা বার্সেলোনার খেলোয়াড়রা-ডাগআউট। শ্বাসরুদ্ধকর জয়ের পর শতশত ক্যামেরা খুঁজে নিচ্ছে ইতিহাস গড়া মুখগুলোকে। কোচ এনরিকে কিংবা মেসি-নেইমার, কে কাকে জড়িয়ে ধরছেন আর আত্মহারা হয়ে যাচ্ছেন তার হিসেব রাখা দায়। এমন সময়ের একটি ছবিতেই পরে আটকে যাচ্ছে সবার চোখ। ছবিতে স্পষ্ট হয়ে থাকা মুখটি লিওনেল মেসির। চোখ বেয়ে নেমে আসছে আনন্দঅশ্রু।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে, উদযাপনের এক মুহূর্তে কোচ লুইস এনরিকেকে জড়িয়ে আছেন মেসি। গুরু-শিষ্যের এই অমোঘ মিলই হতে পারতো ছবিটির সেরা ক্যাপশন। কিন্তু সেটিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে মেসির চোখের জল। টেনে আনছে নতুন অর্থ- জাদুকর মেসি মানুষ মেসি তখন সমার্থক। আর্জেন্টাইন তারকার চোখ টলটল। ডান চোখের নিচের গালের অংশে চিকচিক করছে জল। ক্যামেরার ফ্ল্যাশে সেটি আরো জ্বল জ্বল করছে ক্ষত-বিক্ষত মেসির ভেতরের না বলা কথা হয়ে।

মেসির না বলা কথা আছে। ফুটবল খেলাটাকেই অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া এই মহাতারকা কি করেননি বল-পায়ের কারিকুরিতে। মোহগ্রস্ত করে রেখেছেন বিশ্বকে। কিন্তু জাতীয় দলকে বড় কোন শিরোপা এনে না দিতে পারায় সমালোচনার আঘাতে জর্জরিত হতে হয়েছে বারংবার। বার্সেলোনার জার্সিতেও অনেকবারই এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে। তিনি তো মানুষ। সব ম্যাচে হয়তো জাদুকর হয়ে ওঠা হয় না তার। পিএসজির মাঠে প্রথম পর্বের ম্যাচেই যেমন ছিলেন নিজের ছায়া। সেটাই সমালোচকদের সুযোগ করে দিয়েছিল। জবাবটা দিলেন ফিরতি পর্বে।

এদিন গোল করেছেন। করিয়েছেন। ম্যাচ জুড়ে ছিলেন চেনারূপে। ম্যাচের ৯০ মিনিটে মাঝ মাঠ থেকে মেসির নিখুঁত মাপের দূরপাল্লার শটেই ডি-বক্সে বলের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে ফাউলের কবলে পড়েন সুয়ারেজ। রেফারি পেনাল্টির নির্দেশ দেন। পেনাল্টি থেকে গোল করে ৫-৫ ব্যবধানে সমতা নিয়ে আসেন নেইমার। মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এই গোলের পরই ইতিহাসে নাম লেখানো শেষ গোল। বার্সা কোয়ার্টারে। সমালোচকদের জবাব দেওয়া সারা। প্রথম লেগে হারের পর সবচেয়ে বেশি সমালোচনায় বিদ্ধ হওয়া মেসির উদযাপনটা তো একটু ভিন্ন হবেই। চোখের বেয়ে নামা জল সেটাকে আরো বেশি করেই ভিন্ন করে রাখল।

ম্যাচ শেষের উদযাপনে অবশ্য এদিন মানুষ মেসির দেখাই মিলল। পুরো দলই আত্মহারা। তাতে কি করলেন না মেসিও। কোচ, সতীর্থ, কর্মকর্তাদের তো জড়িয়ে ধরেছেনই; যেটা সচরাচর করতে দেখা যা না, সেটাও করলেন। দর্শকদের মাঝেই ছুটে গেলেন একবার। উঠে পড়লেন গ্যালারিতে। ন্যু ক্যাম্পের চিরচেনা দর্শকরা মানুষ মেসিকে ছুঁয়ে দেখল, এইতো তাদের মেসি। আর ফুটবল বিশ্ব দেখল পাগলপারা মেসিকে, নতুন উদযাপনের মেসিকে। এমন উদযাপনটা হয়তো শিরোপা উঁচিয়ে ধরেই শেষ করতে চাইবেন মেসি।

যাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ঝরিয়েছেন, সেই এনরিকে যে এই মৌসুম শেষে বার্সা ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। কোচকে শিরোপামাল্যে বিদায় জানাতে বেশি করেই চাইবেন মেসি। ফুটবলে কোচ-খেলোয়াড়ের নান্দনিক জুটি পেপ গার্দিওলা-মেসি যুগলের পর এই এনরিকের সঙ্গেই যে বেশি করে রসায়নটা জমে ওঠে মেসির।



মন্তব্য চালু নেই