মৃত মানুষকেও খেতে দেয় যারা!

সংস্কৃতি আর সাংস্কৃতির মধ্যকার পার্থক্য খুব দৃশ্যমান না হলেও এক নয়। সংস্কৃতি জীবনযাপনের নির্দিষ্ট কিছু অনুষঙ্গকে ঘিরে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে জীবনযাপনের সামগ্রিকতাকেই বলা হয় সাংস্কৃতি। সেদিক বিবেচনায় কোন দেশের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয় তাকে আমরা সংস্কৃতি বলতে পারি।

অন্যদিকে মানুষ তাদের জীবনযাপনের জন্য লিখিত বা অলিখিত বিভিন্ন কায়দায় যে রীতিগুলো গড়ে তোলে এবং সেই রীতি অনুযায়ী যে জীবন প্রক্রিয়া সমাজে পরিলক্ষিত হয় তাকেই বলা হচ্ছে সাংস্কৃতি। তবে এটা সত্যি যে সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাই মানুষকে সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আনতে হয়। যে জাতি যত বেশি তার মূলকে ধরে পরিবর্তিত হতে পারে তারা বর্তমান সমাজ কাঠামোয় তত বেশি অগ্রগামী। আর সেদিক বিচারে বর্তমান পৃথিবীর আদিবাসী জনগোষ্ঠিগুলো অতটা অগ্রগামী নয়। অধিকাংশ সনাতনপন্থী আদিবাসীরা এখনও তাদের পূর্বপুরুষদের রীতিনীতিকেই আদর্শ হিসেবে মানে।

বাংলাদেশের পাবর্ত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলে মোট ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের মধ্যে চতুর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থানে আছেন তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী। চাকমা ভাষার সঙ্গে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষার শুধু উচ্চারণগত দিক থেকে সামান্য পার্থক্য হলেও মিল রয়েছে অনেকাংশে। তবে সংস্কৃতির দিক দিয়ে এ দুয়ের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ভিন্নতা। রাঙ্গামাটি-বান্দরবান জেলায় চাকমা ও বোমাং সার্কেলের অধীনে বসবাস করে তঞ্চঙ্গা আদিবাসীরা। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে কোন মানুষ মারা যাওয়ার পর তার মুখের ভেতর দেয়া হয় একটি ধাতব মুদ্রা। এ মুদ্রাটিকে বলা হয় মুখের টাকা (মুঅতাঙা), মুখের টাকা দেয়ার উদ্দেশ্য মূলত মৃত ব্যাক্তির আত্নাকে পরকালের খরচ দেয়া।

উল্লেখ্য যে, নরম্যাডিক অঞ্চলের মানুষরা আজও মৃতের কপালে প্রচলিত মুদ্রা দিয়ে শ্রাদ্ধশান্তির আয়োজন করেন। তাদের বিশ্বাস মতে, এই মুদ্রা তাকে পরপারের পুলসেরাত পারি দিতে সহায়তা করবে। শুধু নরম্যাডিকদের মধ্যে নয়, প্রাচীন অনেক সভ্যতাতেও এই রীতি প্রচলিত ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলি মিসরের ফারাও ও ব্যবিলনীয় সভ্যতা। পরবর্তীতে এই সভ্যতাগুলোর উৎকর্ষতার কারণে পার্শ্ববর্তী অনেক জনপদই এই রীতি গ্রহন করেছিল।

মুখের টাকা দেয়ার পর তঞ্চঙ্গ্যারা মৃত ব্যাক্তিকে স্নান করিয়ে নতুন সাদা কাপড় পড়িয়ে দেন। তারপর বাশেঁর তৈরি শবাধারের উপর মৃত ব্যাক্তির আপাদমস্তক ঢেকে দেন তারা। পরিচিত জনরা মরদেহের বুকের ওপর টাকা-পয়সা রেখে যান। এই টাকাকে বুকের টাকা (বুগডাঙা)বলা হয়। মৃত্যুর ৭দিন পর পযর্ন্ত মৃত ব্যক্তির পরিবারের লোকেরা কোনো আমিষ আহার করে না। শবদাহ করার পরের দিন মৃত ব্যাক্তির পুত্র সন্তানেরা মাথা মুড়িয়ে ফেলে।

শবদেহকে শ্মশানে নেয়ার আগে ওঝা বা বৈদ্য দিয়ে মৃত ব্যাক্তিকে জীবিতদের থেকে আলাদা করা হয়। শ্মশানে নেয়ার দিন সকাল বেলা বাড়ির উঠানে কাঠের শবাধার বানিয়ে মরদেহ রাখা হয়। তারপর মৃতের জন্য ভাত রান্না করা হয়। সামান্য কিছু ভাত মৃতদেহের মুখে গুঁজে দেয়া হয়। বাকি অংশ কলা পাতায় মুড়ে শবের সঙ্গেই দেয়া হয়। তঞ্চঙ্গ্যাদের বিশ্বাস জীবিত কোন ব্যাক্তি বহু দূরের পথে যেতে যেমন বাড়িতে ভাত খেয়ে আরো কিছু ভাত পুটলি বেধে সঙ্গে করে নিয়ে যায়, তেমনি মৃত ব্যাক্তির সঙ্গেও কিছু ভাত খেতে দিতে হয়।

শবদেহকে শ্মশানে নিয়ে যাবার আগে বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছ থেকে পঞ্চশীল গ্রহন করে শ্মশান যাত্রীরা। তারা তখন মঙ্গল-সূত্র শ্রবণ করে এবং মৃত ব্যাক্তির আত্নার মঙ্গল কামনায় সাধ্য মতো টাকা পয়সা দান করে। শ্মশানে শুকনো কাঠ দিয়ে চিতা তৈরি করা হয়। দক্ষিণ দিকে পা ও উত্তরমুখী মাথা করে শবদেহকে চিতায় তোলে তারা। ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠান শেষে প্রথমে জৈষ্ঠ্যপুত্র কিংবা অনুপস্থিতিতে অন্যপুত্রগন অথবা কোন নিকট আত্নীয় ৭ বার চিতা প্রদক্ষিন করে শবদেহের মুখে এবং চিতায় আগুন দেয়। তবে দুরারোগ্য কোনো সংক্রামক রোগের কারণে কেউ মারা গেলে তাকে দাহ না করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।

শবদাহ শেষে শ্মশান থেকে ফিরে আসা ব্যাক্তিরা স্নান ঘরের দরজায় রাখা চন্দন মিশ্রিত পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে কিছু পানি মাথায় ছিটিয়ে নেয়। এরপর তেতো পানি মুখে দিয়ে শুদ্ধ হয়ে তারা নিজ নিজ গৃহে প্রবেশ করে। শবদাহের একদিন পর পুত্র বা স্বগোত্রীয় কেউ শ্মশানে গিয়ে শবদেহের ছাইভষ্ম থেকে বিভিন্ন অস্থির অংশবিশেষ সংগ্রহ করে একটি নতুন মাটির হাঁড়িতে রেখে সাদা কাপড় দিয়ে হাঁড়ির মুখ বেঁধে রাখে। তারপর পানিতে ডুব দিয়ে মাটির হাঁড়িটি মাথার উপর থেকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়। ডুবে থাকা লোকটি তখন তার ডান হাত পানির উপরে তোলার সঙ্গে সঙ্গে অন্য আরেকজন তার কনিষ্ঠ আঙ্গুলে সুতা বেঁধে তাকে টেনে তুলে নেয়। তঞ্চঙ্গ্যাদের বিশ্বাস এভাবে নদীতে অস্থি ফেলে দিলে অস্থির কোনো একটি অংশ গঙ্গা নদী ও বুদ্ধ গয়ায় গিয়ে পৌঁছাবে। এতে মৃত ব্যাক্তির আত্নার সদগতি হবে।

তবে এ অস্থি বিসর্জনের আগে বাঁশের টুকরো দিয়ে চিতার চারপাশ ঘিরে ৭ প্রস্থ সাদা সূতা পেঁছিয়ে তার উপর চাঁদোয়া খাটিয়ে দেয়া হয়। এ ঘেরের মাঝখানে আবার জল পরিপূর্ণ একটি কলসীর মুখ সাদা কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। তারপর তারা ৪ টুকরো বাঁশের আগায় চারখানা লম্বা সাদা কাপড়ের ফালি বেঁধে শ্মশানের চারকোনায় পুঁতে দেয়। এটাকে ধবজা (থাঙোইন) বলা হয়।

শবদাহের ৬দিন পর সাপ্তাহিক ক্রিয়া অনুষ্ঠান করা হয়। এটাকে বলে সাতদিন্যা। এদিন বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্বারা মঙ্গলসূত্র শ্রবন করা হয়। সমাজের লোকজনদের নিমন্ত্রন করে খাওয়ানো হয়। এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনকারী ব্যাক্তিরা মৃত ব্যাক্তির আত্নার শান্তি কামনা করে টাকা পয়সাসহ বিভিন্ন সামগ্রী ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্যে দান করে।



মন্তব্য চালু নেই