মৃত্যুদন্ড বাতিল যে সব দেশে!

সেই প্রচীনকাল থেকে চলে আসা চোখের বদলে চোখ, হাতের বদলে হাত নেওয়ার আইন; এরপর গোত্রপ্রধানের উৎপত্তি আর নতুন নতুন সব নিয়মের জন্ম- এভাবেই সবসময় চলে এসে রাষ্ট্রের নানাবিধ ব্যবস্থা আর বিধি-নিয়ম। হয়তো তখন রাষ্ট্র ছিল কিংবা ছিলনা। কিন্তু মানুষ তার নিজের মতন করে গোত্র, সমাজ, রাজত্ব, নগর রাষ্ট্র এবং সর্বশেষ শহরের মাধ্যমে চেষ্টা করেছে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করতে ও মেনে চলতে। আর সেই নিয়ম মানার ও নিয়ম ভাঙার মনোভাবই মানুষকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে রাষ্ট্রের দিকে। ১৬৪৮ সালের কথা। সেসময় ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির মাধ্যমে প্রথম রাষ্ট্র তৈরি করে মানুষ। আর সেই সাথে তৈরি করে নতুন সব নিয়ম। তার কিছু জাতীয়, আবার কিছু আন্তর্জাতিক। আর এই জাতীয় আইনবিধির ভেতরে স্থান পাওয়া অন্যতম একটি আইন হচ্ছে মৃত্যুদন্ড।

অনেক রকমের তর্ক-বিতর্ক উঠেছে যুগে যুগে। প্রথমটায় রাষ্ট্র ছিল যুদ্ধভিত্তিক। সেসময় মানুষের মৃত্যু খুব একটা বিচলিত করেনি কাউকে। অন্য দেশ দখলের নেশায় মত্ত ছিল মানুষ। এটাই ছিল রাষ্ট্রের টিকে থাকার প্রধান হাতিয়ার। মৃত্যু নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায়নি কেউ। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ, বিশেষ করে ১৯৪৫ সালের পর পারমাণবিক অস্ত্র-শস্ত্র নির্মানের সাথে সাথে টনক নড়ে সবার। সবাই বুঝতে পারে এবার একটা বিরতি দেওয়া দরকার। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকা- দুজনের কাছে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র পুরো পৃথিবীকে আতঙ্কিত করে তোলে। যেকোন সময় ধ্বংস হয়ে যেতে পারতো তখন আমাদের এই পৃথিবী। কিন্তু এরপরেই আসে আটলান্টিক চার্টার। যুদ্ধের বন্ধ নিশ্চিত করে দেশগুলো একে একে বিভিন্ন কনভেনশনের মাধ্যমে। অস্ত্র নির্মাণ না থেমে থাকলেও কমে যায় অনেকটা। বিশেষ করে রাষ্ট্র দখলের ব্যাপারটা তো আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, যে যুদ্ধের ওপর ভর করে রাষ্ট্র টিকে ছিল সেটাই যখন নেই হয়ে গেল, তখন রাষ্ট্রের কি হবে? রাষ্ট্রও কি নেই হয়ে যাবে যুদ্ধের মতন? না! সেটা হতে দেয়নি মানুষ। আর তাই নতুন কাজ হিসেবে রাষ্ট্র শুরু করে জনকল্যাণকর কাজ। সবার মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা, রাস্তা-ঘাট, হাসপাতাল, বিদ্যালয়-

বিশ্ববিদ্যালয়- সর্বোপরি মানুষের জীবনকে সুখী করে তুলতে নিজেদের সবটা ঢেলে দেয় রাষ্ট্র। আর সেসময়ই চলে আসে মৃত্যুদন্ড বাতিল নিয়ে নানারকম তর্ক-বিতর্ক। মানবিকতা আর মানবাধিকারের কথা উঠে আসে। তৈরি হয় নানা সংগঠন। যাদের কাছ হয় বিশ্বে মানবাধিকার নিশ্চিত করা। মৃত্যুদন্ড দেওয়া মানুষের মানবাধিকারের বিরুদ্ধে- কথাটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এসময়। ধীরে ধীরে সময় আরো যেতে থাকে আর শক্তিশালী হয়ে ওঠে পুরো ব্যাপারটা। অনেক রাষ্ট্রই মৃত্যুদন্ড বাতিলের খাতায় নাম লেখায়।

২০০৭ সালে মোট ২০ টি দেশ মৃত্যুদন্ড কার্যকর রাখে ( রিলিজিয়াস টলারেন্স )। ২০১৪ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দেওয়া তথ্যমতে ২০১২ সালে মোট ২২ টি দেশে প্রায় ৭৭৮ টি মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। ২০১৩ সালে সেটি হয়ে দাড়ায় ৫৭টি দেশে মোট ১,৯২৫ টি। ধীরে ধীরে এর সংখ্যা কমেই চলেছে কেবল। ফাঁসি, ইঞ্জেকশন, মাথা কেটে ফেলা- নানাভাবে চলছে মৃত্যুদন্ডের কাজ। তবে ভালো খবর হচ্ছে এতকিছুর পরেও বর্তমানে মোট ৯৮ টি দেশ আছে পৃথিবীতে যারা মৃত্যুদন্ড বা ফাঁসি দেওয়ার বিরুদ্ধে আইন প্রনয়ণ করেছে। আর সেই দেশগুলো হল-

১. আলবেনিয়া- ১৯৯৫ সালে শেষ মৃত্যদন্ডটি কর্যকর করা হয় আলবেনিয়ায়। এরপর ২০০০ সালে এসে সেটিকে একেবারেই বাতিল করে দেওয়া হয়।

২. আরমেনিয়া- সর্বশেষ এখানে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয় ১৯৯২ সালে। যেটি বাতিল হয়ে যায় ২০০৩ সালে। এরপর আর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়নি কখনো আরমেনিয়ায়।

৩. বুরুন্ডি- এখানে সর্বশেষ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ২০০০ সালে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে এসে সেটা বাতিল করে দেওয়া হয়।

৪. ভুটান- ১৯৭৪ সালে শেষ মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় ভুটানে। আইন প্রনয়ণ করে পুরো ব্যাপারটিকে বাতিল করে দেওয়া হয় ২০০৪ সালে।

৫. চিলি- সরাবশেষ মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় ৯৮৫ সালে। আর মৃত্যুদন্ডের প্রক্রিয়া বাতিল করে দেওয়া হয় ২০০১ সালে।

৬. মন্টিনিগ্রো- এখানে সর্বশেষ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ১৯৯২ সালে। পরবর্তীতে ২০০২ সালে এসে সেটা বাতিল করে দেওয়া হয়।

৭. কাজাকিস্তান- কাজাকিস্তানে শেষ মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয় ২০০৩ সালে এবং সেটি আইনটি বাতিল করা হয় ২০০৭ সালে।

৮. ফিলিপাইন- এখানে শেষ মৃত্যুদন্ডটি হয় ২০০০ সালে আর সেটা বাতিল হয়ে যায় ২০০৭ সালে এসে।

৯. গ্যাবন- এখানে সর্বশেষ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ১৯৮১ সালে। পরবর্তীতে ২০১০ সালে এসে সেটা বাতিল করে দেওয়া হয়।

১০. মাদাগাস্কার- মাদাগাস্কারে শেষ মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় সেই ১৯৫৮ সালে আর আইনটি বাতিল করে দেওয়া হয় ২০১৪ সালে।

১১. উজবেকিস্তান- এখানে সর্বশেষ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ২০০৫ সালে। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে এসে সেটা বাতিল করে দেওয়া হয়।

১২. তুরস্ক- তুরস্কে ১৯৮৪ সালে শেষ মৃত্যুদন্ডটি কর্যকর হয়। পরবর্তীতে ২০০২ সালে এসে সেটিকে বাতিল করে দেয় দেশটি।

১৩. টোগো- এখানে সর্বশেষ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ১৯৭৮ সালে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে এসে সেটা বাতিল করে দেওয়া হয়।

১৪. সার্বিয়া- এখানে সর্বশেষ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ১৯৯২ সালে। পরবর্তীতে ২০০২ সালে এসে সেটা বাতিল করে দেওয়া হয়।

১৫. সেনেগাল- সেই ১৯৬৭ সালে শেষ মৃত্যুদন্ডটি কার্যকর করা হয় সেনেগালে। সেটি শেষমেশ ২০০৪ সালে এসে বাতিল বলে ঘোষনা করে দেশটির সরকার।

এছাড়াও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আরো দেশ নিজেদের নাম লেখাচ্ছে মৃত্যুদন্ড বাতিল করার খাতায়। এই যেমন- বেনিন ( ২০১২), লাটভিয়া ( ২০১২ ), মঙ্গোলিয়া ( ২০১২ ), মাদাগাস্কার ( ২০১২ ), চাদ ( ২০১৪ ), ফিজি ( ২০১৫ ) এবং সুরিনাম ( ২০১৫ ), কিছুদিন আগেও এখানে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করবার আইন প্রচলিত থাকলেও ধীরে ধীরে সেটা বাতিল করেছে তারাও। তবে সৌদি আরব আর ইরানে এখনো অব্দি একইভাবে চলে আসছে মৃত্যুদন্ডের কার্যকলাপ ( নিউইয়র্ক টাইমস )। পশ্চিমা বিশ্বের ভেতরে কেবল উন্নত ৫ টি দেশ বাকি আছে যারা এখনো মৃত্যুদন্ডকে বাতিল বলে ঘোষনা করেনি। আর সেই দেশগুলো হচ্ছে- আমেরিকা, জাপান, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান এবং সেইন্ট কিটস এন্ড নেভিস। ইউরোপে এখন কেবল বেলারুস রয়ে গিয়েছে এই তালিকায়। বাদবাকীরা মৃত্যদন্ডের আইন বাতিল করেছে অনেক আগেই।

পৃথিবীর বেশিরভাগ মৃত্যুদন্ড এশিয়ায় কার্যকর হলেও এখানকার বেশকিছু দেশ এই আইন বাতিল করেছে বা করতে চলেছে এর ভেতরে। আর তাদের ভেতরে রয়েছে আমাদের দেশ বাংলাদেশের নামও।



মন্তব্য চালু নেই