মিষ্টি মেয়ে জোসনা

ভাদ্র মাসের সকাল। বাইরে রোদের তাপ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে । রাশেদ নয়টার ট্রেনটা ধরার জন্য দ্রুত পা চালিয়ে স্টেশনে পৌঁছাল । স্টেশনে পৌঁছে জানতে পারল ট্রেন আসতে ঘন্টা খানেক বিলম্ব হবে । অগত্যা স্টেশনে অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই । স্টেশনে সারি সারি নিম
গাছ । রাশেদ ঘুরে ঘুরে বড় নিম গাছটির তলায় পাঁকা বেঞ্চটিতে এসে বসল । স্টেশনের সামনের দিকে বিস্তৃত খোলা ফসলের মাঠ । মাঠের পরে নদী ।
নদীর বুক থেকে উঠে আসছে ঝিরি ঝিরি হাওয়া। অল্পক্ষনেই রাশেদের হাটার ক্লান্তি দুর হয়ে গেল । ভাদ্রের তাল পাঁকা রোদ যেন বরফের কুঁচি হয়ে গায়ে এসে ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে । রাশেদ খোলা মাঠের পানে অপলক তাকিয়ে আছে । সবুজ আমন ধানের কঁচি চারা গুলো বাতাসের তালে তালে এদিক ওদিক দোল খাচ্ছে ।
স্টেশন ঘরের দিক থেকে মাঝ বয়সী এক মহিলা একটি ছোট্র মেয়ের হাত ধরে রাশেদের দিকে এগিয়ে এল । রাশেদ বসে বসে কৈশোরে এ স্টেশনের স্মৃতি গুলো রোমন্থন করছে । তখন রেল স্টেশনটি সারাক্ষন জমজমাট থাকত । মালামাল বুকিংসহ প্রচুর যাত্রী স্টেশন থেকে ট্রেনে যাতায়াত করত । এথন রেল স্টেশনে তেমন একটা লোক নেই । কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা । ভদ্র মহিলা রাশেদের কাছা কাছি এসে মেয়েটির হাত ধরে দাড়িয়ে পড়ল । দাড়িয়ে দাড়িয়ে নিবিড় ভাবে রাশেদকে দেখল ।
আচমকা ভদ্র মহিলা রাশেদ কে প্রশ্ন করল- আপনি রাশেদ ভাই না ?
রাশেদ মুখ তুলে তাকাল । মহিলার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল । মহিলা তার নাম জানল কি ভাবে ? রাশেদ মহিলাকে কখনো দেখেছে বলে তো মনে পড়ছে না । রাশেদ জবাব দিল-হ্যাঁ আমি রাশেদ ।
কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনতে পারলাম না । আপনি আমার নাম জানলেন কি ভাবে ?
মহিলা নির্বিকার ভাবে জবাব দিল আমি জোসনা ।
জোসনা; এ নামে তো আমার কোন আত্নীয়া বা পরিচিত কেউ আছে বলে মনে পড়ছে না ।
মহিলা বলল- আমি বেঞ্চটাতে একটু বসি ?
হ্যাঁ হ্যাঁ বসুন বসুন বলে রাশেদ মহিলাকে বসার জায়গা করে দিল ।
মহিলা ছোট্র মেয়ে টিকে নিয়ে বেঞ্চটির এক মাথায় বসে পড়ল ।
রাশেদ ভাই সত্যিই আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না ?
রাশেদ আবার নিবিড় ভাবে মহিলাকে দেখল । মহিলার গায়ের রং ফর্সা । মুখটা একটু লম্বাটে । নাক চোখ মুখের আদলের সাথে মানান সই । বয়স আনুমানিক পয়তাল্লিশ কি ছিচল্লিশ হবে । পড়নে জর্জেট শাড়ী । বেশ ভুষায় পরিচ্ছন্নতার ছাপ । রাশেদ বলল সত্যিই আমি আপনাকে চিনতে পারছি না ।
মহিলা এবার বলল- মনে আছে আমি প্রতি দিন আপনাদের বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতাম । আপনার কলেজ ছুটি থাকলে আপনি বাড়ীর সামনে আম বাগানে রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে থাকতেন । স্কুলে যেতে আসতে প্রায়ই আপনার সাথে দেখা হতো । আপনাকে দেখলেই ভাল ভাবে দেখার জন্য দলের সবার পেছনে চলে যেতাম । যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে । একদিন দুপুরে আপনি বাগানে ঘুমিয়ে ছিলেন । আমি ছুটি নিয়ে একা বাড়ী যাচ্ছিলাম । অনেকক্ষন আপনাকে একা পেয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিলাম । আপনার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আপনার কাছে অংক শেখার বায়না ধরে ছিলাম । আপনি আমাদেরকে বেশ কয়েক দিন অংক শিখিয়ে ছিলেন ।
রাশেদের মনে পড়েছে । ছোট খাট গড়নের একটি মেয়ে ছিল জোসনা । মিষ্টি চেহারা । আর দশটি মেয়ে থেকে একটু আলাদা । তারা সবাই সামনের গ্রাম থেকে হেটে স্কুলে যেত ।
রাশেদ বলল হ্যাঁ হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে । তুমি সেই জোসনা । কতদিন পর দেখা । এবার বল কেমন আছ ? কোথায় থাক ? তোমার স্বামী কি করেন ? তোমার ছেলে মেয়ে কজন ইত্যাদি প্রশ্ন করে জোসনার বর্তমান আবস্থা জানতে চাইল ।
এস এসসি পাশ করার কিছু দিন পর বাবা মা আমাকে বিয়ে দেয় । আমার স্বামী পাশের গ্রামের ফারুক আহম্মেদ । তিনি আপনি যে কলেজে পড়তেন সে কলেজেরই ছাত্র ছিল । তাকে হয়তো আপনি চেনেন । তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরী করেন । রাশেদের মনে পড়েছে । ফারুক রাশেদ সহ আরোও দশ বার জন একই ট্রেনে কলেজে যাতায়াত করত । ফারুক রাশেদের এক ব্যাচ সিনিয়র ছিল ।
জোসনা বলল আমরা ঢাকায় বাসাব তে থাকি । ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে তিনি সেখানে দোতলা বাড়ী করেছেন । আমাদের দু মেয়ে এক ছেলে । মেয়ে দুটো বিয়ে দিয়েছি । ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে । আমার সাথের এই মেয়েটি বড় মেয়ের প্রথম সন্তান । আপনার ছেলে মেয়ে কজন ? এখন কোথায আছেন ?
রাশেদ বলল আমি ঢাকাতেই থাকি ।একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে প্রকল্প পরিচালক হিসাবে চাকরী করি । বাসা উত্তরায় । আমার একটি ছেলে । এ লেভেলে পড়ে । আমার স্ত্রী একটি বেসরকারী ব্যাংকে চাকরী করেন ।
জোসনা বলল- আজ আর বলতে লজ্জা নেই প্রায়ই আপনাকে দেখতে দেখতে ও স্কুলে আপনার প্রসংসা শুনতে শুনতে আমি আপনাকে ভাল বেসে ফেলে ছিলাম । দিনে দিনে আপনাকে আমার আপন ভাবতে শুরু করে ছিলাম । কিন্তু কথাটা আপনাকে কখনো বলতে পারিনি । এক এক দিন ভাবতাম আজ আপনাকে আমার মনের কথাটা জানাব কিন্তু সামনে এলেই সব গুলিযে যেত । আবার ভাবতাম কথাটা শুনে যদি আপনি আমাকে বেহায়া ভাবেন । তাহলে তো আমার লজ্জার শেষ থাকবে না । অংক করার ছলে আমি আপনার সান্যিধ্য পেতে চেয়ে ছিলাম । একবার নাকি জ্বরের ঘোরে সারা রাত আপনার নাম জপ করেছিলাম । পর দিন ভাবী “‌‍‍রাশেদ কে” ? জানতে চেয়ে ছিল । আমি বলতে পারিনি । আপনি এইচ এসসি পাশ করে ঢাকায় চলে গেলেন । আমি বহু দিন স্কুল থেকে ফেরার পথে আপনাদের বাড়ী গিয়েছি । যদি আপনার খোঁজ পাই । আপনার ভাবীদের সাথে গল্প করেছি । কিন্তু লজ্জায় আপনার কথা জিঞ্ছেস করতে পারিনি ।
নিম গাছ থেকে মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটায় কচি কচি নিম ফল গায়ে এসে পড়ছে । মনে হচ্ছে জোসনা তার মনের ভেতরে বহু দিনের লুকিয়ে রাখা কথা গুলো বলতে পেরে তৃপ্ত । দক্ষিনা বাতাস যেন তার মনকে সকল যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিয়েছে । ট্রেন আসার ঘন্টি বেজে উঠল । টিকিট কাটতে হবে । তারা উঠে পড়ল । রাশেদ দ্রুত গিযে তিনটি টিকিট কেটে দুটো জোসনার হাতে দিতে গেল । জোসনা আমতা আমতা করে টিকিট দুটো হাতে নিল । ট্রেন এসে গেল । ট্রেনে প্রচন্ড ভীর। ভীর ঠেলে জোসনা আর তার নাতনীকে রাশেদ একটি কামরায় উঠিয়ে দিল । ট্রেন ছেড়ে দিল । চলন্ত ট্রেনে রাশেদ পরের কামরায় উঠে বসল ।
বিমান বন্দর ষ্টেশনে এসে রাশেদ ট্রেন থেকে নেমে জোসনাদের কামরার সামনে এসে দাড়াল। জোসনা জানালায় মুখ গলিয়ে রাশেদ কে বিদায় জানাল । ট্রেন ছেড়ে দিল জোসনা অপলক দৃষ্টিতে যতদুর দেখা যায় রাশেদের দিকে তাকিয়ে রইল । স্টেশন থেকে বের হয়ে রাশেদ একটা রিকসায় চড়ে বসল ।
পথে যেতে যেতে রাশেদের শৈশব জীবনের কথা মনে পড়তে লাগল । রাশেদদের বাড়ীর সামনে আম বাগান । বৈশাখে ঝড় শুরু হলেই দল বেধে আম কুড়ানো, বর্ষায় দল বেধে বিলে সাতার কাটা, বিল থেকে শাপলা তোলা, বড়শীতে মাছ ধরা, ডুব দিয়ে পানির নিচ থেকে শালুক তোলা, শীত কালে আচল ভর্তি করে মুড়ি নিয়ে খড়ের গাদায় বসে সকলে মিলে মুড়ি খাওয়া, গরমের দিনে সন্ধ্যা হলেই উঠানে মাদুর বিছিয়ে দাদীর কোলে মাথা রেখে আকাশের তারা গুনা, রাক্ষস খোক্ষসের গল্প শোনা ইত্যাদি ।
রাশেদদের বাগানের পাশ ঘেষে জেলা পরিষদের রাস্তা । পুর্ব দিক থেকে বড় মাঠ পেড়িয়ে রাস্তাটি রাশেদদের গ্রামে ঢুকেছে । বাগানের সামনে এসে রাস্তাটি দুদিকে চলে গেছে । উত্তর দিকের রাস্তাটি গ্রাম ছাড়িয়ে দুর দুরান্তে চলে গেছে । হাট বার শত শত লোক এপথ ধরে যাওয়া আসা করে । কারো মাথায় পাটের বোঝা, কারো মাথায় ধান. আবার কারো মাথায় সওদা পাতি । রাশেদদের স্কুলটিতে বড় রাস্তাদিয়ে যেতে হয়।
জোসনা সহ একদল মেযে প্রতিদিন পুর্বদিকের গ্রাম গুলো থেকে মাঠ পেরিয়ে রাশেদদের বাড়ী ছাড়িয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করে । রাশেদদের পড়ার ঘর থেকে রাস্তায় লোক জনের আসা যাওয়া লক্ষ্য করা যায় । রাশেদ সে দিন বাগানে রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে ছিল । স্কুল গামী একদল মেয়ে তার সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছে । দলে সবার থেকে আলাদা ও নজর কাড়া একটি মেয়ে । পাশের গ্রামের বেশ কয়েকটি মেয়েকে রাশেদ চিনলেও এ মেয়েটিকে রাশেদ আজই প্রথম দেখল । পরে জানা গেল মেয়েটি নূতন । এ বছরই মেয়েটি স্কুলে নবম শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছে । নাম জোসনা বাড়ী শান্তিপুর ।
রাশেদের এইচ এসসি পরীক্ষা শেষ । সারা দিন বাড়ীতেই বই আর গল্প করে কাটায় । জৈষ্ঠ মাস বাইের প্রখর রোদ । আকাশে মেঘের ছিটে ফোঁটাও নেই । রোদ বাড়ার সাথে সাথে টিনের চালার গরমে ঘরে টেকা দায় । এদিকে জমিতে নিড়ানী দেওয়ার সময় । কৃষি শ্রমিকরা কিছুক্ষন পর পর জমি থেকে উঠে এসে গাছ তলায বসছে । কিছুক্ষন ঠান্ডা হয়ে আবার জমিতে যাচ্ছে । দাবদাহ শুরূ হয়েছে । মাঝে মাঝে বাতাসের সাথে গরম লু হাওয়া এসে গা পুড়িয়ে দিচ্ছে । রাশেদ কোন রকমে দুপুরের খাবার খেয়ে শীতল পাটি ও একটি বালিশ হাতে নিয়ে বাগানে এল । গাছের ঘন ছায়ায় বিছিয়ে শুয়ে পড়ল । বাগানে গাছে গাছে থোকা থোকা আম ঝুলছে । আমে সামান্য পাঁক ধরেছে । মাঝে মাঝে দমকা বাতাসে আমের থোকা দোল খাচ্ছে । কচি পাট গাছ বাতাসে দোলনার মত দুলছে । মাঝে মাঝে একটা দুটা পাঁকা আম টুপ করে কোথাও পড়ছে ।
দেখতে দেখতে রাশেদের তন্দ্রা এসে গেল । কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানেনা । আধা ঘন্টা হবে হয়তো । টুপ করে একটি পাঁকা আম রাশেদের পায়ের কাছে এসে পড়ল । ঘুম ভেঙ্গে গেল । চোখ খুলেই সে অবাক । তার কাছা কাছি দাড়িয়ে তার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে রয়েছে একটি মেয়ে। রাশেদ উঠে বসে পড়ল । মেয়েটি লজ্জা পেয়ে দুপা পিছিয়ে গেল ।
রাশেদ বলল-এ সময়ে তুমি এখানে ? আর সবাই কোথায় ? তোমার নাম কি ?
মেয়েটি জবাব দিল আমার নাম জোসনা । শরীরটা ভাল লাগছেনা তাই ছুটি নিয়ে চলে এসেছি । রাস্তায় অনেক রোদ তাই এখানে ছায়ায় একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম ।
আচ্ছা রাশেদ ভাই আপনি নাকি অংকে খুব পটু । আমাকে কয়টা অংক দেখিয়ে দেবেন ?
রাশেদ বলল তুমি আমার নামও জান দেখছি । জোসনা বলল আপনি ছিলেন আমাদের স্কুলের সেরা ছাত্র সবাই আপনাকে এক বাক্যে চেনে । আর আমি নাম জানবনা । ক্লাসে স্যারেরাতো প্রায়ই আপনার প্রসংসা করেন । আপনাকে নিয়ে গর্ব করেন ।
রাশেদ বলল আজ সম্ভব নয় ভাই ।
জোসনা বলল কেন ?
একেতো ভীষন গরম অন্য দিকে তুমি অসুস্থ । বাড়ী যাও । সুস্থ হয়ে একদিন এসো দেখিয়ে দেব ।
জি আচ্ছা বলে জোসনা বাড়ীর পথে পা বাড়াল । যেতে যেতে বার বার ফিরে ফিরে রাশেদ কে দেখল ।
জোসনা চলে যাবার পর রাশেদের লেংটা কালের সাথী রমিজ পাটক্ষেত নিড়ানী ফেলে রাশেদের কাছে এসে বসল । বসেই জানতে চাইল- মাইয়াডা কে রে ? এতক্ষন ধরে মাইয়াডার লগে কি ফুসুর ফুসুর করলি ? এক ঘন্টা ধরে এত কি কথা ?
এক ঘন্টা কোথায় দেখলি ? মাত্র তো মিনিট দশেক হবে ।
রাশেদ তুই যখন থেকে পাটি বিছিয়ে শুয়েছিস তখন থাইক্কা ভাবছি এই লাইনটা শেষ করেই তোর কাছে এসে বসব । লাইনটা শেষ হবার আগেই দেখি মাইয়াডা এসে হাজির । ইতি মধ্যে আমি তিনটি লাইন শেষ করেছি তবুও তুই বলছিস মাত্র দশ মিনিট । তোরা লেখা পড়া জানা মানুষ । তোদের কথার মাঝে এসে ডিসটাব করতে চাইনাই বলে আসিনি । দেখ আমি কেমন ঘেমে গেছি ? এবার বল মাইয়াডারে কি তুই ভাল বাসিস ।
রাশেদ বলল দুর বোকা । ভাল বাসব কেন ? মেয়েটি পথে হাটার ক্লান্তি দুর করতে একটু জিরিয়ে নিয়েছে ।
আমিতো ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম । গাছ থেকে পাঁকা আমটা পায়ের উপর পরায় ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে । চোখ মেলে দেখি মেয়েটা দাড়িয়ে আছে । দাড়িয়ে থাকতে দেখে তার নাম জানতে চেয়েছি । মেয়েটি আমাকে কয়েকটা অংক দেখিয়ে দিতে বলেছে । আমি আজ সম্ভব নয় বলে বিদায় করেছি ।
রমিজ বলল তবে তুই যাই বলিস মাইয়াডা কিন্তু খুব সুন্দর । মাইয়াডা কোন ক্লাসে পড়ে রে । হের বাড়ী কই ?
রাশেদ বলল- নাইনে পড়ে । বাড়ী নাকি শান্তিপুর ।
শান্তিপুরের কার মাইয়া তা জানিস ?
রাশেদ বলল- এত কিছু জানিনা ।
এভাবে গল্প করতে করতে বেলা পড়ে এল । রোদের তেজ কমে এসেছে । রমিজ নিড়ানী হাতে নিয়ে জমির দিকে এগিয়ে গেল । রাশেদ পাটি আর বালিশ হাতে নিয়ে বাড়ীর ভেতর পা বাড়াল ।
ইতিমধ্যে একদিন ঝড় বৃষ্টি হয়ে গেল ।গরমের তীব্রতা কমে এসেছে । এক সপ্তাহ পর দুপুর বারটার দিকে রাশেদ ঘরে বসে একটা বইয়ে চোখ বুলাচ্ছে ।জোসনা তার এক বান্ধবীকে নিয়ে রাশেদদের বাড়ী এসে হাজির । রাশেদ তাদের বসতে দিল । জানতে চাইল কোন অংক তারা বুঝতে চায় । রাশেদ বেশ কয়েটি জটিল বীজ গণিত তাদের বুঝিয়ে দিল । জোসনার করুন আবদারে কথা দিতে হল সপ্তাহে অন্তত একদিন তাদের অংক দেখিয়ে দেবার । দেখতে দেখতে দুই মাস কেটে গেল । জোসনার কাছে জানা গেল । জোসনার বাবার চাকরী সূত্রে তারা বিভিন্ন জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছে । তার বাবা চাকরী থেকে অবসর নেওয়ায় তারা গ্রামে ফিরে এসেছে । এখন থেকে তারা গ্রামেই থাকবে । তারা তিন ভাই বোন । জোসনা সবার ছোট ।
বর্ষা শুরু হল । একনাগারে সাতদিন বাদলা চলল । মাঠ ঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে যেতে লাগল । কোথাও কোথাও রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে গেল ।স্কুল বন্ধ হল । ফলে জোসনাদের আসাও বন্ধ হল ।
রাশেদের পরীক্ষার ফল বেড়িয়েছে । রাশেদ ঢাকা প্রকেৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল । শুরু হল শহর মুখী জীবন । ক্লাস আর পড়ার চাপে গ্রামে আব খুব একটা যাওয়া হয়ে উঠেনা । গেলেও এক রাতের বেশী থাকা হয়না । দিনে দিনে গ্রাম, গ্রামের মানুষ, আত্নীয় পরিজন দুর থেকে দুরে চলে যেতে লাগল । নাড়ীর টানে ভাটা পড়ে এল । একে একে বন্ধু বান্ধব, সেই প্রিয় স্কুল, স্কুল গামী ছাত্রের দল হারিয়ে গেল । জীবন নামক ঘুর্নি চাকার ঘুর্নি পাকে কেটে গেছে বহু দিন বহুমাস বহু বছর । আজ প্রায় দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর পর রেল স্টেশনে জোসনার সাথে দেখা । সেদিনের মিষ্টি মেয়ে জোসনা আজ আধপৌঢ়া। লাজুক জোসনা আজ প্রগলভা । রিকসা বাসার সামনে এসে গেছে । রাশেদ রিকসা থেকে নেমে বাসায় ঢুকে পড়ল ।

লেখক : বশির আহমেদ



মন্তব্য চালু নেই