মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে নির্ধারিত ফি টেকসই নয়

মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানোর জন্য সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া অর্থ কোনোভাবে বাস্তবায়ন হবে না এমন ধারণা বিশেষজ্ঞ ও এজেন্সি সংস্থাগুলোর। ৩৭ হাজার টাকায় মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানো সম্ভব নয়, কারণ প্রাথমিক খরচ অনেক বেশি। সরকারের এই নির্দেশ বাস্তব রূপ দেখবে না, বরং এজেন্সিগুলো তাদের মতো করে কর্মীদের থেকে টাকা আদায় করবে এমনটা বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

মালয়শিয়ায় কর্মী পাঠানোর সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে এজেন্সিগুলো। সরকারের তরফ থেকে শুধু মনিটরিং চলবে। এ জন্য সরকার নির্ধারিত ৩৭ হাজার টাকায় কোনভাবে কর্মী পাঠানো সম্ভব হবে না। কারণ দূতাবাস থেকে শুরু করে মেডিকেল, ট্রেনিং ও টিকেট সকল প্রক্রিয়া এজেন্সির হাতে। সরকারের তরফ থেকে মনিটরিং করা হবে যেন কর্মীদের থেকে এজেন্সি অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা না হয়।

‘জি টু জি’ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর ফলে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কর্মী পাঠানো সম্ভব হবে। কয়েক বছর পর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে মালয়েশিয়া। এক বছর আগে এ বিষয়ে চুক্তি হলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। তবে প্রক্রিয়া চলছে, আগামী সপ্তাহ থেকে মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানো শুরু হবে।

প্রথম পর্যায়ে মালয়েশিয়াতে ৫ হাজার দুইশ বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। নির্মাণ শিল্প, প্ল্যান্টেশন ও ম্যানুফ্যাকচার খাতে তাদের নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আরো কর্মীর চাহিদা আসছে। সরকারের টার্গেট আগামী তিন বছরে ১৫ লাখ কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠানো।

এদিকে সরকার নির্ধারিত ৩৭ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বাস্তবে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক হাসান আহমেদ কিরন চৌধুরী।

তিনি জানান, ‘বিমান ভাড়া ও ইমিগ্রেশন খরচ এবং কর্মীদের মেডিকেল চেকআপ যোগ হলে সাধারণত ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। এরপর ট্রেনিং খরট দুই হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত অর্থ বাস্তবে বাস্তবায়ন হবে না।’

সরকার কর্মী পাঠানোর জন্য যে অর্থ নির্ধারণ করেছে তা ‘টেকসই পদ্ধতি’ নয়? এমনটা উল্লেখ করে হাসান আহমেদ বলেন, ‘সরকারের উচিত যারা জনশক্তি পাঠায় এবং যারা নেয়, তাদের সাথে বৈঠক করে নতুন একটা খরচ নির্ধারণ করা। আর সেটা না করলে কাগজে-কলমে ৩৭ হাজার টাকা থাকলেও বাস্তবে লাখ টাকা খরচ হবে কর্মীদের।’

এতো কম টাকায় কর্মী পাঠানো কোনভাবেই সম্ভব নয় এমন কথা জানান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব আব্দুস সালাম।

তিনি বলেন, ‘ভিসা কিনে আনতে হয়। এরপর টিকেট, আম্বাসি, মেডিকেল সব মিলিয়ে খরচ অনেক। একটা ভিসা কেনার জন্য যে প্রতিযোগিতা চলে, তাতে এতো অল্প টাকায় কর্মী পাঠানো কোনোভাবে সম্ভব নয়।’

তিনি জানান, ‘সব থেকে বেশি ঝামেলা মেডিকেলে। সরকার নির্ধারিত ৫ হাজার ৮’শ টাকা দিয়ে হয় না। অনেক ঝামেলা সেখানে। তারপর টিকেট নিয়ে ঝামেলা। যখন কর্মী পাঠানো শুরু হয় সেই সময় টিকেটের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকারি বা বেসরকারি যত স্থান রয়েছে সব জায়গায় বাড়তি টাকা দেয়া লাগে।’

তবে মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর ও সৌদি আরবে একজন কর্মী পাঠাতে লাখ টাকা খরচ হয় না- জানান তিনি।

‘কম টাকায় কর্মী পাঠানো মডেল হতে পারে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এতো কম টাকায় কর্মী পাঠানো সম্ভব নয়। একজন কর্মী পাঠিয়ে ২০ হাজার টাকা লাভ করতে না পারলে, অফিস খরচ চালানো সম্ভব নয়’ বলেন সাবেক এই বায়রা নেতা।

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বলেন, ‘টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয় কিন্তু তা মানে না সবাই। অতিরিক্ত টাকা নেয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রমাণ থাকে না বিধায় ব্যবস্থা নেয়া যায় না।’

তিনি বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত অর্থে কর্মী পাঠানো বাস্তবায়ন আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। এবার চ্যালেঞ্জ নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের মনিটরিং জোরদার করা হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের টিম গঠনের চেষ্টা চলছে। এবার মাত্র ১০টি এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাবে। তাদের মনিটিরিং করা সহজ হবে।’

বিদেশে কর্মী পাঠানো টেকসই করতে সরকার সবকিছু মার্কেটের হাতে ছেড়ে একদম ছেড়ে দেয়নি জানিয়ে এই সচিব বলেন, ‘টেকসই করার লক্ষ্যে জি২-জি পদ্ধতি নেয়া হয়েছে। মার্কেটের হাতে একদম ছেড়ে দেয়নি। সরকার এখানে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।’

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফারুকী বলেন, ‘মালয়েশিয়া সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাইছি না এই মুহুর্তে। এই বিষয়টা আমি বুঝে উঠতে পারছি না। লোক পাঠানো শুরু না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না।’

‘আগামী সপ্তাহে কর্মী যাওয়া শুরু করবে’ জানালে তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি। আগামী সপ্তাহ করতে করতে এক বছর হয়ে গেছে। না যাওয়া পর্যন্ত বলতে পারছি না। মেডিকেল শুরু হোক, যাওয়া শুরু হোক তারপর বলতে পারবো।’

মালয়েশিয়াতে লোক পাঠানোর টেকসই পদ্ধতির বিষয়ে কিরন চৌধুরী বলেন, যে এজেন্সিগুলো কর্মী পাঠাবে তাদের সামান্য লাভ হিসেব করে অর্থ নির্ধারণ করে দেয়া উচিত সরকারের। তাহলে গোপনে লাখ লাখ টাকা কর্মীদের থেকে নেয়া বন্ধ হবে এজেন্সিগুলোর। এছাড়া এজেন্সিগুলোর ভিসা কেনার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধে একটা নিয়ম করে দেয়া হোক।

সরকার যদি এজেন্সিগুলোকে প্রতি কর্মী পাঠানো বাবদ ৫০০ ডলার করে দেয়, তাহলে সরকার নির্ধারিত অর্থে কর্মী পাঠানো সম্ভব। তা না হলে এজেন্সিগুলো আগের মতো মিথ্যা বলে কর্মী পাঠাবে।

টেকসই পদ্ধতি প্রসঙ্গে সাবেক মহাসচিব বলেন, ভিসা কেনাবেচা চললে আগের মতো ২ থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হবে। এ বিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে।



মন্তব্য চালু নেই