মাগুরার এসপি বাবুল আক্তার কেন সারাদেশে আলোচিত?

মোঃ কাসেমুর রহমান শ্রাবণ, মাগুরা প্রতিনিধি : চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার বাবুল আক্তারের জন্ম ১৯৭৫ সালে ঝিনাইদহের শৈলকুপার মদনপুর গ্রামে। বাবা আবদুল ওয়াদুদ মিয়া ও মা শাহিদা বেগম।

২০০৪ সালে মাহমুদা আক্তারের সঙ্গে সংসারজীবন শুরু করেন। দুটি সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহির ও আক্তার তাবাচ্ছুম তানজিলা। বাবুল আক্তারের পরিবার বর্তমানে মাগুরা শহরের কাউন্সিলপাড়া এলাকার বাসিন্দা। এখানে তার বাবা মা ও ছোটভাই এ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান অবস্থান করেন। তার অপর এক ভাই সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

রবিবার সকাল সোয়া ৭টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি মোড়ে মোটরসাইকেলে করে এসে তিন দুর্বৃত্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়।

সারাদেশে অনেক পুলিশ অফিসার আছে। তার মধ্যে মাগুরা শহরের কাউন্সিলপাড়া নিবাসী বাবুল আক্তারের নাম বিভিন্ন সময় মিডিয়াতে বিশেষভাবে উঠে এসেছে । কেন আলোচিত বাবুল আক্তার? এটা জানতে আরেকটু পেছনে চলে যেতে হবে।

বিপদে পড়লেই সাধারণ মানুষ দ্বারস্থ হয় তাঁর। সহযোগিতা চায়। বাবুল আক্তার নিরাশ করেন না, বরং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার বাবুল আক্তার সাহসী এক অফিসার, সুযোগ্য এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। নানা পদকেও ভূষিত হন তিনি

হাটহাজারী থেকে বিদায়ের সময় পুলিশ বিভাগ সুযোগ্য অফিসার বাবুল আক্তারকে একটি স্যুট উপহার দিল। স্যুট তৈরির জন্য টেইলার্সে গেলেন। স্যুট ডেলিভারি নেওয়া হলো না। তড়িঘড়ি চলে যেতে হলো নতুন কর্মস্থল কক্সবাজারে। কিছুদিন পর একটি পার্সেল এলো বাবুল আক্তারের ঠিকানায়। সেটা খুলে অবাক হয়ে দেখলেন, সেই স্যুটের পাশাপাশি আরো একটি স্যুট তাঁকে উপহার দেওয়া হয়েছে। হতবাক বাবুল ফোন করলেন টেইলার্সের মালিককে। তিনি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘স্যার, আপনি আমাদের এলাকার অনেক উপকার করেছেন। কখনো কিছু করার সুযোগ পাইনি। ভালোবেসে এটা আমরা তৈরি করে পাঠিয়েছি। কিছু মনে করবেন না, এটা আমাদের ভালোবাসা।’

কোনো এক বছরের ৭ ডিসেম্বরের ঘটনা। চট্টগ্রাম ইপিজেড থানা এলাকা থেকে অপহৃত হন চাকরিজীবী আবুল কালাম। বাবা বেলায়েত বিশ্বাসের কাছে ছয় লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। স্থানীয়দের পরামর্শে ভাই শহীদুল ইসলাম ছুটে আসেন বাবুল আক্তারের কাছে। অপহরণের পুরো বৃত্তান্ত শুনে সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়লেন বাবুল। অপহরণকারীদের দেওয়া ‘বিকাশ’ নম্বর নিয়ে জেনে নিলেন সেটি কোথায় ব্যবহার করা হচ্ছে। আরো কিছু তথ্য উদ্ধারের পর ফোন করলেন সেই নম্বরে, ‘আমি বাবুল আক্তার বলছি, তোমার নম্বরে টাকা পাঠাতে বলা হয়েছে। আমি তোমার অবস্থান দেখতে পাচ্ছি। তুমি ওদের বলো কামালকে ছেড়ে দিতে। না হলে আমি আসছি। ওদের সঙ্গে তুমিও এমন নানা মুশকিলের যিনি আসান করেন, সেই বাবুল আক্তার পুলিশে যোগ দেন ২০০৫ সালে। সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে র‌্যাব-২-এ কর্মজীবন শুরু। যোগদানের পরের বছর পুলিশ কর্মকর্তা পুরান ঢাকা থেকে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার জাল সনদ, সনদ তৈরির কারখানা এবং এই অপকর্মের দুই হোতাকে আটক করেন।

২০০৭ সালে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিলেন ‘ভয়ংকর’ ছয় খুনের রহস্য উন্মোচনের দায়। নরসিংদীর ভেলানগরে সে বছরের ১৮ মে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটে। একই পরিবারের ছয় সদস্যকে খুন করে ঘরের ভেতরেই লাশগুলো বস্তাভর্তি করে রাখা হয়েছিল চার দিন। ঘটনার তদন্তের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি চান র‌্যাব অফিসার বাবুল। অনুমতি পাওয়ার পর শুরু হয় বাবুলের অভিযান। ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব ঘুরে গ্রেপ্তার করেন বীরুকে। তার সূত্র ধরে পুরো হত্যারহস্য উন্মোচন করে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। মামলার বিচার শেষে আসামিদের ফাঁসির রায় দেন আদালত।

এ ছাড়া স্কুলশিক্ষিকা তানিয়া হত্যারহস্য উদ্ঘাটন; ১৪ বছরের কিশোর জাভেদকে অহরণকারীদের হাত থেকে অক্ষত উদ্ধার ও অপহরণরহস্য উদ্ঘাটন; গৃহকর্মী রুমাকে হত্যার পর পুড়িয়ে সব আলামত নষ্টের পরও সূত্রহীন সেই হত্যাকাণ্ডের সূত্র উদ্ঘাটন করে আসামিদের গ্রেপ্তার; রাউজানের বেসরকারি ব্যাংকের ভল্ট থেকে ৩৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা চুরির হোতা গ্র্যাজুয়েট চোরচক্রকে গ্রেপ্তার; চট্টগ্রামের ভয়ংকর ডাকাত সর্দার খলিলকে ৯ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার ও মালামাল উদ্ধার, অজ্ঞান-মলমপার্টি-মোটরসাইকেল চোরচক্র গ্রেপ্তার, ডাকাতির প্রস্তুতি নেওয়ার সময় রকেট লঞ্চার, ছয় অস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদ উদ্ধার, দুর্র্ধষ ক্যাডার বিধান বড়ুয়ার কাছ থেকে জি-থ্রি রাইফেল উদ্ধার; চট্টগ্রামের কাদের ডাকাত ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলার ত্রাস কিলার ওসমানকে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করেছেন বাবুল আক্তার।

সিএমপিতে যোগ দিয়েই সর্বশেষ পুলিশ মার্ডার মামলার আসামি গ্রেপ্তার ও খুনের কাজে ব্যবহৃত ‘কাটনি’ উদ্ধার করে দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। আর এসব সাফল্যের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে পেয়েছেন স্বীকৃতি- রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক পিপিএম (সেবা) (২০০৮), ২০০৯ পিপিএম (সাহসিকতা), ২০১০ সালে আইজিপি ব্যাজ, ২০১১ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল পুরস্কার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (সাহসিকতা)। সর্বশেষ বেসরকারি পর্যায়ে ২০১২ সালে সিঙ্গার-চ্যানেল আই (সাহসিকতা) পুরস্কার লাভ করেছেন বাবুল আক্তার। আর এর মধ্যে চার-চারবার অর্জন করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের সেরা সহকারী পুলিশ সুপারের মর্যাদা।
কৃতি পুলিশ অফিসার বাবুল আক্তার

‘আইকন’ বাবুল আক্তারকে নিয়ে গর্ব করে বাংলাদেশ পুলিশ। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে রাজারবাগ প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরস্কার তুলে দেওয়ার আগ মুহূর্তে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বাবুল আক্তারকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘বাবুল আমাদের সবচেয়ে সাহসী অফিসার।’ শুনে প্রধানমন্ত্রী বাহবা দিলেন। বাবুল আক্তার দ্বিতীয় দফা স্যালুট দিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রী বাবুলের বুকে পরিয়ে দিলেন ‘বিপিএম’ মেডেল।

তবে পুলিশ সদস্য হিসেবে যিনি এত খ্যাতি-সম্মান লাভ করেছেন, তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষক হতে। কিন্তু হয়ে গেলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তবে সেই খেদ আজ আর নেই বাবুলের ভেতর। নানা অপরাধের রহস্য উন্মোচনের পর যে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, সেটার কোনো তুলনা নেই।
নেট থেকে সংগৃহীত তথ্য।



মন্তব্য চালু নেই