মনো বিহার : বাপ্পি হাসান

নতুন বিয়ে করা পুরুষের অহঙ্কারের বস্তু একটাই, তা হলো তার সুন্দরী স্ত্রী। স্ত্রী যদি সুন্দরী হয় তাহলে হৃদয়ে সব সময়ই অহঙ্কারের বাতাস বইতে থাকে। মাহাবুব ওর স্ত্রীর রূপের কারুকাজে এতোই মুগ্ধ যে! কোন অনুষ্ঠান এলেই বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে পরিচিতদের মাঝে আগবাড়িয়ে স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দেয়। অনেকটা স্ত্রীর রূপের ব্যানারে যেনো নির্বাচন করে যাচ্ছেন। তবে এ অহঙ্কার বেশিদিন স্থায়ী হলো না। স্ত্রীর রূপের কোন কমতি হয়নি! রূপ যা ছিলো, এ কয় মাসে বরং তা আরো কয়েক গুন বেড়ে গেছে। এ বাড়তি রূপের কারণেই সমস্যায় পরেছে মাহাবুব। এখন আর মিরাকে কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। কোথাও গেলে ছেলেরা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে মিরার দিকে। শুধু তাই না, একটু সুযোগ পেলে মিরাও আলাপ জুড়িয়ে দেয় ছেলেদের সাথে। এতে মাহাবুব স্ত্রী অহঙ্কার বাদ দিয়ে স্ত্রীর রূপের জন্য অনেকটা বিদ্বেষে লিপ্ত হয়েছে। এখন আর আগের মতো প্রসাধনী এনে দেয় না। না পারলে কোথাও ঘুরতেও নিয়ে যায় না। তবে এবার বিয়ে বার্ষিকিতে মিরা বায়না ধরেছে তাকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। মাহাবুব রাজ্যের সকল ব্যস্ততা দেখিয়েও কোন পার পেলো না। আবশেষে মিরাকে নিয়ে সমুদ্র ভ্রমনে বের হতেই হলো।

রাত ন’টার ট্রেন, মিরা ঘ্যানঘ্যান করে সেই সাড়ে সাতটায় কমলাপুর স্টেশনে নিয়ে এসেছে। বসে থাকতে থাকতে মিরার প্রতি খুব রাগ হচ্ছে। পুরুষ হিসেবে মাহাবুবের রাগও আছে, তবে সুন্দরী স্ত্রীর সাথে বেশি রাগ করা যায় না। তাই রাজ্যের সকল রাগ দাতে চেপে কৃত্রিম হাসি মুখে বসে আছে মিরার সামনে। মিরা বক বক করেই যাচ্ছে। আর এদিকে মাহাবুবের মন নানান ঝামেলার আশঙ্কায় জলচ্ছ্বাসের মতো তোলপার করছে। সমুদ্র দেখতে যাওয়া নয় তো! ছেলেদের দৃষ্টি থেকে নিজের সুন্দরী স্ত্রীকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়ে পাহারাদার নিযুক্ত হতে যাচ্ছে। শুধু কি ছেলেদের দোষ? কোন ছেলে পেলেই কথা জুড়িয়ে দেয়া মিরার এখন একটা স্বভাব হয়ে দাড়িয়েছে। এটা মিরা বলে না, পৃথিবীর সকল সুন্দরীরাই চায় তার আসে পাসে ছেলেরা মৌমাছির মতো ঘুরে বেরাক।

মিরার আহ্লাদের কথায় হু হু করে সায় দিচ্ছে মাহাবুব। মেয়েরা যেমন সহজে ছেলেদের মনযোগ আকর্ষণ করতে পারে, তেমনি কেউ অমনযোগী থাকলেও ধরতে পারে সহজে। তাই মাহাবুবের অমনযোগ লক্ষ্য করে মিরা রেগে মাহাবুবকে বলে ‘কি ব্যপার? আমি এত সুন্দর সুন্দর কথা বলছি আর তুমি আমার কথা বাদ দিয়ে ধ্যানে বসেছো?’ হঠাৎ করেই জোরে ব্রেক কশার মতো করে মাহাবুব ধ্যান থেকে ফিরে এলো। ‘কই? আমি তো তোমার কথাই শুনছিলাম।’ মিরা ওর অমনযোগীতার ভাব দেখে আরো বিরক্ত হয়- ‘বলো তো আমি কোথায় কোথায় ঘুরার কথা বলেছি? কি কি করার কথা বলেছি?’ মাহাবুব যেনো মহা মুসকিলে পরেগেলো, কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। কারণ ও সত্যিই কিছু শুনেনি। তাই সাহস নিয়ে বলে ফেললো – ‘আমরা যেহেতু সমুদ্র দেখতে যাচ্ছিই, তাহলে সব জায়গায়ই ঘুরে আসবো! আবার কোথায় কোথায় কেনো?’ মাহাবুবের এ কথায় মিরা রাগে আগুন হয়ে গেলো – ‘তার মানে তুমি আমার একটা কথাও শুননি! আমার মুড টাই নষ্ট করে দিলে তুমি। আমি যাবো না সমুদ্র দেখতে, তুমি একা যাও।’
মাহাবুব যেনো অনেকটা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। একটু খুশি হয়েই বললো।

‘তাহলে কি বাসায় চলে যাবে? চলো সেটাই ভালো। একেই বর্ষা। এর মধ্যে জল দেখতে এতো দূরে যাওয়ার কি দরকার! এরচেয়ে বরং আমরা চিড়িয়াখানায় যেয়ে পশুপাখি দেখে আসবোনে।’

মাহাবুবের কথা শুনে মিরার রাগ যেনো আরো ফুসে উঠলো। ‘বিয়ে বার্ষিকিতে নিয়ে যাবে চিড়িয়াখানায় পশুপাখি দেখতে? আমাকে নিয়ে তুমি সমুদ্র দেখতে যেতে চাচ্ছ না, ওটা আগে বললেই পারতে। এখানে এসে তারপর বলছো -চিড়িয়াখানায় যাই, না? তুমি আমাকে নিয়ে কোথাও যেতেই চাও না। আসলে তুমি আমাকে আগের মতো ভালোই বাসো না।’ মিরা অনেকটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। সুন্দরী মেয়েরা ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদার ভান করলে অনেক সুন্দর লাগে। তার পরেও স্টেশনে বসে স্ত্রীর এ রূপ না দেখলেও চলবে। তাই মিরার ফুঁপিয়ে কাঁদা থামানোর জন্য বলে-
‘ তুমি ই তো বললে যে তুমি আমার সাথে যাবে না। তাহলে আমি কি করবো বলো? আচ্ছা যাইহোক এখন ঠাণ্ডা হয়ে বসো আমি তোমার জন্য ঠাণ্ডা কিছু নিয়ে আসি।’

মিরাকে ঠাণ্ডা করার জন্য ঠান্ডা পানি আনতে গিয়েছে মাহাবুব। স্টেশনে সব কিছুরই দাম বেশি। কিছু কিনলেই পাঁচ টাকা বেশি গুনতে হয় এখানে।
ঠাণ্ডা পানি নিয়ে ফিরে এসে মাহাবুব অবাক। পানি আনার আগেই মিরা ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাসি মুখে অপরিচিত এক যুবকের সাথে কথা জুড়িয়ে দিয়েছে। কে বলবে এ মেয়ে কিছুক্ষণ আগেও রেগে আগুন ছিলো? যে কারণে ওকে নিয়ে কোথাও যায় না আজ বাসা থেকে বের হয়েই সে কারণের সূচনা করে বসেছে। এখন মাহাবুব নিজেই রেগে আগুন।
‘কি ব্যপার, তুমি কার সাথে কথা বলছো?’

মিরা মিষ্টি হেসে বলছে ‘পরিচয় হও, ইনি কক্স বাজারই যাচ্ছে। সাথে কেউ নেই। ওনার সাথে আমাদের সময়টা ভালোই কাটবে।’
মিরা এভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে! মনে হচ্ছে যেনো ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটি এই মাত্র ট্রেনে করে ফিরে এসেছে। মাহাবুব রাগে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। ‘একা যাক বা গার্লফ্রে- সাথে করে নিয়ে যাক, তাতে তোমার কি? তুমি কথা বলছো কেনো?’
‘এই তুমি এভাবে কথা বলছো কেনো? মানুষটা কি ভাববে?’ মিরা ছেলেটাকে বলে ‘আপনি কিছু মনে করবেন না। ও একটু এমনই। ও ছেলে মানুষ হলেও কোন ছেলে মানুষ ও সহ্য করতে পারে না। সবাইকে ওর মতো বদ মনে করে।’

মিরার এ কথা শুনে মাহাবুব তো পারলে মিরাকে তুলে আছার দেয়, সাথে ছেলেটাকেও। কিন্তু ছেলেটা অপরিচিত বলে তা আর হলো না, তবে মিরাকে ঠাণ্ডা করার জন্য আনা ঠাণ্ডা পানির বোতলটিই ধপাস করে আছাড় দিয়ে রাগের একটু উপশম ঘটালো। মাহাবুবের এ আচরণে একটি হ্যানসাম ছেলের সামনে মিরা ভীষণ অপমান বোধ করলো। তাই এ অপরিচিত ভদ্র ছেলেটির সামনেই দুজনের তুমুল ঝগড়া বেধে গেলো। সে কি ঝগড়া! দু জনের মাথাই আগ্নেয়গিরির মতো উত্তপ্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই ট্রেনের হুইসেল ঝগরার বারটা বাজিয়ে দিলো। ট্রেনের হুইসেলের শব্দে দুজনই এক পর্যায়ে ঠান্ডা হলো, তবে যে ভদ্র হ্যানসাম ছেলেটির জন্য এতো ঝগড়ার সৃষ্টি হলো সে ভদ্র হ্যানসাম ছেলেটি আর নেই। মিরা তাকে যে সরি বলবে এ সময়টুকু না দিয়েই ভদ্রলোকটি উধাও। আসলে ভদ্রলোকেরা কারো সরির জন্য অপেক্ষা করে না। মিরা আবার চড়াও হলো মাহাবুবের উপর ‘তোমার ব্যবহারে ভদ্রলোকটি চলে গেলো। একটু সরি বলবো সে সময়টুকুও পেলাম না। মানুষটা কি ভাববে?’ ভদ্রলোকের ভাবনা শেষ না হতেই আরেক ভাবনা এসে পরলো মিরার মনে। শুধু ভদ্রলোকটি নয়, ওদের ব্যাগগুলোও সে ভদ্রলোকের সাথে উধাও। মিরা মাহাবুবের দিকে তাকিয়ে বলছে ‘ আমাদের ব্যাগ গুলো কোথায়?’
‘কোথায় আবার? তোমার সে ভদ্রলোক নিয়ে ভেগেছে।’

মিরা যেনো আকাশ থেকে পরলো। বলতে বলতে আবেগে কেঁদেই ফেললো ‘কি বলো? এতো সুন্দর চেহারার মানুষ কি কখনো চুরি করতে পারে?’
‘তাহলে কে নিয়েছে? এখানে তুমি আমি আর তোমার সে ভদ্রলোক চোর ছাড়া আর কে ছিলো?’
মিরা যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না, এত সুন্দর ছেলে মানুষ কি করে ব্যাগ নিয়ে পালালো। এখন মন খারাপ করে বসে আছে, মাহাবুবকে কিছু বলতেও পারছে না। কারণ এখন কিছু বললেই ঝারি খাবে। তাই নিজে থেকেই বলছে, ‘যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। অল্পতেই সাবধান হয়েগেছি। যদি ওখানে যাওয়ার পরে সব নিয়ে যেতো? তখন কি করতাম বলো?’ অনেক কিছু হারানোর পরেও মিরার কথা শুনে মাহাবুবের রাগ বরফ গলা পানির মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। মাহাবুব একটু খুশি মনেই মিরার হাতটি ধরলো। এদিকে কক্স-বাজারের ট্রেনটি হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে গেলো।



মন্তব্য চালু নেই