মদ খাবো নাকি গাঁজা!

বেশি দিন আগের কথা নয়। আফিমের মতো মাদকদ্রব্য নিয়ে চীনে ব্যাপক গন্ডগোল হয়ে গিয়েছিল। শুধু গন্ডগোল বললে ভুল হবে, রাষ্ট্রযন্ত্র পর্যন্ত টলে গিয়েছিল এই আফিমের কারণে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চক্রান্তে চীন থেকে ব্রিটিশ ব্যবসায়িরা রৌপ্য নিয়ে যেত এবং তার বদলে জাহাজ ভর্তি আফিম নিয়ে আসতো চীনে। অবশ্য এই আফিম যে বৃটেনে চাষ করা হতো, তা কিন্তু নয়। ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশদের আফিম চাষের আধার। এখান থেকেই চীনে আফিম পাঠানো হতো। ইতিহাস সাক্ষী চীনে আফিম নিয়ে যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছিল, যাকে বলা হয় ‘আফিম যুদ্ধ’। সেই যুদ্ধের পর গোটা বিশ্বেই মোটামুটি মাদকদ্রব্যের উপর একপ্রকার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শুরু হয়ে যায়। দেশে দেশে প্রতিবাদ প্রতিরোধ হতে থাকে মাদকদ্রব্যের উপর। নতুন নতুন আইন করা হয় মাদকদ্রব্য নিয়ে।

মনে আছে, আমার শৈশবে পুরোন ঢাকার অনেক অলিগলিতে কিছু নির্দিষ্ট দোকান দেখা যেত যেখানে সুলভ মুল্যে গাঁজা বিক্রি করা হতো। কিন্তু একটা সময় আবগারি শুল্ক আরোপ করে সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়। সর্বত্র পোস্টার ব্যানার দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয় গাঁজা-মদ খাওয়া অপরাধ, এগুলো সেবন করলে জেল জরিমানা পর্যন্ত হবে। এরকমই চলছিল অনেকটা দিন-বছর। কিন্তু হঠ্যাৎ করেই বুঝি পাশার ছক পাল্টে গেল। ২০১০ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে জোর আন্দোলন শুরু হয় গাঁজাকে বৈধ করে দেয়ার জন্য। এই আন্দোলন গুটি গুটি করে দুবছর পার করার পর ২০১২ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আন্দোলনকারীদের কথা শুনতে বাধ্য হয়। চিকিৎসা খাতে ব্যবহার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার কিছু প্রদেশে গাঁজাকে বৈধ করে দেয়। এই বৈধকরণ প্রক্রিয়া এক বছর যেতে না যেতেই গোটা যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ করে দেয়া হয় গাঁজা। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের রেশ ধরে আরও কয়েকটি দেশ গাঁজাকে বৈধ করে দেয়। মূলত এই সিদ্ধান্তের পরপরই শুরু হয়, বিশ্ববাসীর মনে মাদক প্রশ্নে নৈতিক দোদুল্যমানতা।

যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি আপনার সন্তানকে গাঁজা নাকি মদ খেতে দেবেন? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই প্রশ্নের উত্তর হবে ‘কোনোটিই নয়’। কিন্তু আপনি শাসনের মাধ্যমে সন্তানকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত না হয় মদ-গাঁজা থেকে দূরে রাখতে পারবেন। কিন্তু সন্তান যখন বড় হবে তখন কিন্তু বৈধ গাঁজা-মদ তাকে টানবেই। কারণ সমাজ বৈধকরণের পেছনেই ক্রমাগত ছুটে যায়।

১১গাঁজা শরীরের জন্য ভালো না মন্দ তা নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই ইতোমধ্যে অনেক গবেষণা করে ফেলেছেন। তবে সব বিজ্ঞানীই এটা দাবি করেছেন যে, গাঁজা সেবনের ফলে মস্তিস্কে পরিবর্তন ঘটে। পাশাপাশি ফুসফুস এবং হৃদপিন্ডেও বিরুপ প্রভাব ফেলে। এতো গেল শরীরী ব্যাপার। কিন্তু খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্সিলের দেয়া এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ অপরাধ, ৩৭ শতাংশ ধর্ষণ, ২৭ শতাংশ মারামারির পেছনের কারণ মাদকদ্রব্য। তবে এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে আরও একটা তথ্য জুড়ে দেয়া আছে, সেটা হলো- যারা অতিরিক্ত মদ-গাঁজা সেবন করেন তারা সামাজিকভাবে হুমকির কারণ নয়। গত ২০১০ সালে মদ খাওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আশি হাজার মানুষ মারা যায়, ২০১২ সালে এই সংখ্যাটা ছিল আরও বেশি।

পৃথিবীতে মদ খেয়ে অনেক মানুষ মারা গেলেও এখন পর্যন্ত গাঁজা সেবন করে মানুষের মৃত্যু হয়েছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। সুইডেন সরকার একবার ৪৫,০০০ গাঁজাসেবীর উপর টানা ১৫ বছর গবেষণা করেছিলেন। সেই জরিপে দেখা যায়, গাঁজাসেবী মানুষদের তুলনায় যারা গাঁজা সেবন করে না তাদের শারীরিক সমস্যার হার বেশি। আর এই জরিপটিকেই প্রতিপাদ্য ধরে সুইডেন সরকার গোটা দেশে গাঁজা সেবন বৈধ করে দেয় এবং সরকারি উদ্যোগে শহরের বিভিন্ন স্থানে বৈধ গাঁজার দোকান প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সুইডেনের দেখাদেখি নেদারল্যান্ডও একই কাজ করে।

ঠিক এরকম একটি অবস্থা থেকেই গোটা বিশ্বে আজ প্রশ্ন উঠেছে, আপনার সন্তান গাঁজা খাবে নাকি মদ খাবে?। মানবিক দিক বিচারে গাঁজা এবং মদ দুটিই বর্জনীয়। সামাজিক নৈতিকতার অবস্থান থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে দেশ-কাল-পাত্র ভেদে মাদকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহন করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যা বৈধ বাংলাদেশে তা বৈধ নাও হতে পারে। আবার বাংলাদেশে যা বৈধ তা গোটা বিশ্বেই বৈধ নাও হতে পারে।



মন্তব্য চালু নেই