কন্যাশিশুর অধিকার লঙ্ঘন

ভয়ে ‍চুপ থাকে যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুরা

রাইমার (ছদ্মনাম) বয়স আট। খুব পছন্দ করতো চকলেট খেতে। হঠাৎই বন্ধ করে দেয় চকলেট খাওয়া। চাকরিজীবী মাকে অফিসে যেতে বাধা দেয়। মা স্কুলে পৌঁছে দেয়। গাড়িচালক স্কুল শেষে বাসায় নিয়ে আসে। কিন্তু সে স্কুলে যেতে চায় না। হঠাৎ তার এ ধরনের অস্থির আচরণের কারণ খুঁজে পায় না তার অভিভাবকরা। ভাবে শিশুর অহেতুক বায়না। এমন চলতে থাকে কয়েক মাস। একসময় মা বুঝতে পারেন মেয়ের শারীরিক পরিবর্তন দ্রুত ঘটছে। মেয়ের আচরণে হঠাৎই বড়দের মতো ভাব এসে গেছে। কথা বলে আরও কয়েক মাস পর বুঝতে পারেন মেয়ে গাড়িচালকের দ্বারা নানা সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়। চালক চকলেট দিয়ে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে রাইমাকে চুপ করিয়ে রেখেছিল। মেয়ে শেষপর্যন্ত এই নির্যাতনের ভার বইতে না পেরে মার কাছে বলে, কাকু (ড্রাইভার) তাকে ব্যথা দেয়।

দেশে প্রতি ১০ জন কন্যাশিশুর মধ্যে ৭ জন যৌন নির্যাতনের শিকার হয় এবং কোনও কন্যাশিশুই তাদের নিপীড়নের কথা বলেন না। সামাজিক গবেষণা বলছে- মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে বোধ তৈরির পর থেকেই শরীর নিয়ে ভয়ভীতি কাজ করে বলেই তারা নিপীড়ন মুখ বুঝে সহ্য করতে শেখে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ও ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স-এর গবেষণায় এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার হচ্ছে শিশু (যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে)। এই শিশুদের মধ্যে মেয়ে শিশুর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৩৯ লাখ।

শুধু রাইমা না, কাছের মানুষদের দ্বারা এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় মেয়েশিশুরা। সম্প্রতি লালবাগের ইসলামবাগে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া এক ছাত্রীকে (১১) ধর্ষণের অভিযোগে আটক করা হয়েছে রাসেল নামের নিরাপত্তাকর্মীকে। শিশুটিকে ঢামেক হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়।

নারীনেত্রীরা বলছেন, বাংলাদেশে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা, বিশেষত যৌন হয়রানির ঘটনা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। যদিও অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। তাদের গবেষণা অভিজ্ঞতা থেকে তারা বলছেন, কন্যাশিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হলে নিজেরা অজানা শঙ্কায় চুপ থাকে বা অভিভাবকরা জানলে তারা ঘটনাটি চাপা দিয়ে রাখতে চান। এমনকি বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার সময় কোনও কন্যাশিশু যদি যৌন হয়রানির শিকার হয় তবে সে তা তার বাবা-মাকে বলতে ভয় পায়।

আইনজীবী দীপ্তি রানী সিকদার মনে করেন, মেয়ে শিশু নির্যাতনের যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ছয় বছরের কন্যাশিশু ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পায় না। তিনি বলছেন, সমাজের বিবেক যদি জাগ্রত না হয়, পরিবার যদি অভয়াশ্রম না হয় সেক্ষেত্রে এ সমস্যার সমাধান হবে না।

তিনি আরও বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে যে আইনগুলো আছে সেগুলো বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

এদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, আমাদের সামনে যখন নারী ও কন্যাশিশুদের যৌন হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করতে অনেকগুলো আইন আছে এবং নির্যাতন তারপরও কমছে না তখন এটা স্পষ্ট যে শুধু আইন প্রণয়ন যথেষ্ট না। তিনি বলেন, আইনের প্রয়োগ বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে এবং পাশাপাশি সব অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।

শিশুবিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স-এর রোকসানা সুলতানা বলেন, নির্যাতনের শিকার শিশুটি যেন তার কথা বলতে শেখে সেটা নিয়েই তাদের কাজ। তিনি আরও বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে নির্যাতনটা এতো কাছের স্বজনদের দ্বারা ঘটে যে আইডেন্টিফাই (চিহ্নিত) করা কঠিন হয়ে যায়। একশ্রেণির বিকৃত মানসিকতার মানুষ দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কন্যাশিশু ও কিশোরীরা। যৌন নির্যাতন শুধু ধর্ষণ না; ইশারা, স্পর্শ, কথা, অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে শিশুকে যে নির্যাতন করা হয় কোনও কোনও ক্ষেত্রে শিশুটিকে সেই অভিজ্ঞতা আজীবন বহন করে বেড়াতে হয়।

উদিসা ইসলাম



মন্তব্য চালু নেই