ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছে উত্তরার কিশোর বখাটেরা

রাজধানীর উত্তরায় উঠতি কিশোর-তরুণরা মিলে গড়ে তুলেছে ভয়ংকর বখাটে দল। এলাকায় মোটরসাইকেল প্রতিযোগিতা, গান-বাজনা, খেলার মাঠ, ডান্স পার্টি, ক্লাবের আড্ডাসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া এমন দুটি গ্রুপ।

এলাকার আতঙ্ক হয়ে ওঠা এই গ্রুপ দুটির একটির নাম ‘ডিসকো গ্রুপ’, অন্যটি ‘নাইনস্টার গ্রুপ’। পুলিশ ও স্থানীয় একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
লেখাপড়া ফাঁকি দিয়ে বখাটেপনায় মেতে ওঠা এই উঠতি তরুণদের মধ্যে এখন এলাকার আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে। তাদের দ্বন্দ্বেই গত শুক্রবার সন্ধ্যায় খুন হয় নাইনস্টার গ্রুপের ১৪ বছরের কিশোর আদনান কবির। ডিসকো গ্রুপের সদস্যরা হকিস্টিক ও চাপাতি নিয়ে তার ওপর হামলা চালায়। আদনান খুনের তিন দিন আগে দুই গ্রুপের মধ্যে আরেক দফা মারামারি হয়। এভাবে গত তিন মাসে অন্তত চারবার সংঘর্ষে জড়ায় তারা।

আদনান খুনের তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, শুক্রবার রাতে আদনানের বাবা কবির হোসেন উত্তরা পশ্চিম থানায় নাইনস্টার গ্রুপের ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ রাতেই সাবেক এক জেলা জজের ছেলে নাফিস মোহাম্মদ আলম ওরফে ডন (১৮) এবং ছাদাফ জাকিরকে (১৬) গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল শনিবার আদালতের নির্দেশে তাদের একদিনের রিমান্ডে নিয়েছেন তদন্তকারীরা।

প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এলাকায় নিজেদের গ্রুপের আধিপত্যের বিরোধে পাল্টা হামলায় নিহত হয় আদনান। তবে স্বজনরা দাবি করছে, আদনান কোনো গ্রুপে জড়িত ছিল না।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবিরকে খেলার মাঠে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে মারাত্মক আহত করে প্রতিপক্ষ। চিকিৎসার জন্য তাকে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে আদনানের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ছোটন, আদনান ও ছাদাফসহ কয়েকজন মিলে উত্তরা এলাকায় গড়ে তোলে ডিসকো গ্রুপ। এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তালাচাবি রাজুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় নাইনস্টার গ্রুপ। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই দুই গ্রুপের মধ্যে কিছুদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে এলাকাবাসী। এই গ্রুপের কিশোর ও তরুণরা লেখাপড়া ফাঁকি দিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। তারা এলাকায় উচ্চ শব্দে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালায়। বখাটে এসব ছেলে এলাকার স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের প্রকাশ্যে উত্ত্যক্ত করে। খেলার মাঠে মাদকের আড্ডা বসায়। বিভিন্ন বিশেষ দিবসে অনুষ্ঠানের নামে তারা এলাকাবাসীর টাকায় ডান্স পার্টি করে। সাইবার ক্যাফেগুলোয় অশ্লীল ভিডিও দেখার আসর জমায়।

নাম প্রকাশ না করে একাধিক স্থানীয় অভিযোগ করে, বখাটে গ্রুপগুলোর ব্যাপারে পুলিশকে বলা হলেও পুলিশ উদাসীন। অভিভাবক, সোসাইটি ও কমিউনিটি পুলিশেরও কোনো কার্যকর তত্পরতা নেই।

সূত্র জানায়, গত তিন মাসে ডিসকো গ্রুপ এলাকায় তিন-চারটি ঘটনা ঘটিয়েছে। গত ৩ জানুয়ারি তুরাগ থানা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক সফিক, ছাত্রলীগকর্মী রূপক, ছাকিব এবং কমিউনিটি পুলিশের সদস্য ছালাম সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। এ ঘটনায় পরদিন তুরাগ থানায় মামলা করা হয়। একই দিনে উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকার ১৪ নম্বর সেক্টরে জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান বাহাউদ্দিন বারুলের ভাতিজা দীপু সিকদারকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এই দুটি ঘটনার সঙ্গেও ডিসকো গ্রুপ এবং নাইনস্টার গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের সম্পর্ক রয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

আদনান হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই শাহিন মিয়া বলেন, শুক্রবার ডিসকো গ্রুপের হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারায় আদনান কবির। আদনানের বাবা কবির হোসেন শুক্রবার রাতে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ১০-১২ জনের নামে মামলা করেন। গ্রেপ্তার ডন ও ছাদাফ জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (অপারেশন) শাহ্ আলম বলেন, ডিসকো গ্রুপের সদস্যরাই আদনানকে হত্যা করেছে। বখাটে ছেলেরা লেখাপড়া ফেলে এসব করছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। নিহত আদনান এবং গ্রেপ্তার ছাদাফ মাইলস্টোন স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। পরে আদনান ট্রাস্ট স্কুলে ভর্তি হয় বলে জানা গেছে। গ্রুপগুলোর ব্যাপারে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।

জানা গেছে, নিহত আদনানের বাবা কবির হোসেন একজন ব্যবসায়ী। তাঁর বাসা উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর রোডে। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। আদনানের চাচা রফিকুল ইসলাম বলেন, ব্যাডমিন্টন খেলতে ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে মুনা নামে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার পথে ডিসকো গ্রুপের সদস্যরা চাপাতি এবং দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আদনানকে হত্যা করে। গতকাল আসরের নামাজের পর উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।

আদনানের মামা জিয়াউল হক বলেন, ‘আমার ভাগ্নে কোনো গ্রুপে জড়িত ছিল না। সে র‍্যাকেট নিয়ে খেলতে যায়। মাঠে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে তাকে এভাবে মারা হলো। আমরা এর বিচার চাই। ’ তিনি আরো বলেন, ‘একটা গ্রুপ এলাকায় অনেক ত্রাস করছে বলে শুনেছি। প্রশাসন ব্যবস্থা নিলে তারা মার্ডার করতে পারত না। ’



মন্তব্য চালু নেই