সাম্প্রতিক কলামঃ

ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন ও কিছু কথা

লিও টলস্টয় খুব সুন্দর ও যুক্তিসম্মত একটা কথা বলেছিলেন- “জনগণের অজ্ঞতাই সরকারের শক্তির উৎস।” বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টলস্টয়ের এই উক্তি যে পুরোপুরিই বাস্তবসম্মত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।কারণ এদেশে মৌলিক অধিকারও আন্দোলন করে আদায় করে নিতে হয়।আন্দোলন ছাড়া যেন আমাদের দেশে কোন কিছুই সম্ভব নয়।আজকের এই পৃথিবীর এতো রূপ উচ্চশিক্ষার কারণে, যার জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের নাম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম নয়।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় এই সংকটকে সুযোগে রূপান্তর করে শিক্ষা-বাণিজ্য বিস্তারে বাজার তৈরি করতে পেরেছেন দেশের বড় বড় বণিক ব্যবসায়ীরা! তাই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন।যদি আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করি তাহলে দেখব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সরকারের কেমন যেন উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গি। শিক্ষাখাতে সরকারের এই উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষাকে নিয়ে ব্যাবসা করার জন্য পুরোপুরিই অনুকূল।বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এই বিশাল জনসংখ্যার উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করা সম্ভব নয় সেখানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা এ নিয়ে বাণিজ্য করবেন, জালিয়াতি করবেন, এসবই যেন স্বাভাবিক।

যদিও শিক্ষা এদেশের একটি মৌলিক অধিকার,কিন্তু রাষ্ট্রের বিভিন্ন অপ্রতুলতার কারণে এ মৌলিক অধিকারটি অর্থের বিনিময়ে অর্জন করে দেশের ছাত্রসমাজের সিংহভাগ।ভর্তি পরীক্ষা নামক “ফিল্টার” এর মাধ্যমে তাদেরকে আলাদা করা হয় প্রথম থেকেই।ভর্তি পরীক্ষায় অনেক মেধাবী হোঁচট খায় বিভিন্ন কারণে,বড় হওয়ার বিভোর স্বপ্নে ভর্তি হয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে।একটা ছাত্রের মন মানসিকতা তখন থেকেই বারবার জবাই করা হয়।একে তো পাবলিকে চান্স না পাওয়া আরেকদিকে পিতামাতার নতুন এক বোঝা হিসেবে আত্নপ্রকাশ করা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করলেই শিক্ষার্থীরা ধনকুবের পরিবার থেকে আগত, কালো টাকার মালিক—এমন অবান্তর ধারণা অনেকের থেকে থাকলেও সরকার ও সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এমন ধারণার প্রকাশ শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারকে ঢালাওভাবে অসম্মান করে।শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে অর্থমন্ত্রীর ধমকি দিয়ে কথা বলাটা অশোভনীয়। মাসে ১০০০ টাকা খরচা করলে ৭৫০ টাকা দিতে পারবে না কেন, এমন স্বরে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলাটা শিষ্টাচার বিবর্জিত, তা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অবশ্যই সমালোচনার যোগ্য।তারা কোন পাপ কাজ করে নাই যে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আজকে পড়ালেখার উপরে ৭.৫% ভ্যাট দিতে হবে।

বাস্তবতা যে বড়ই নির্মম এটি হয়তো উচ্চ আসনে বসে থাকা অনেকের জানা নেই।বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। যারা বিদেশে গিয়ে শিক্ষা নেওয়ার মতো অর্থ খরচ করতে ভরসা পান না, তারা অন্তত দেশেই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করিয়ে সন্তানের শিক্ষার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেন। দেখা যায়-অনেকের বাবা-মা তাঁদের সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে গিয়ে ফসলের জমিটুকু বিক্রি করে দিয়ে অন্যের জমিতে কামলা দেন, কিংবা শেষ জীবনে নিজেদের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে তিল তিল করে জমানো সঞ্চয় ভেঙ্গে দিয়ে বাকি জীবনটা বাড়িওয়ালাকে কুর্ণিশ করতে করতে কাটিয়ে দেন। কেও আবার সন্তানের সেমিস্টার ফি’র টাকা যোগাড় করতে গিয়ে দিনের পর দিন ডাক্তারের কাছে না গিয়ে শরীরে সাময়িক আশ্রয় নেয়া ব্যাধিটাকে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দেন। মায়ের গয়না বিক্রি আর বাবা’র এক কাপড়ে তিন তিন ঈদ পার করে দেয়ার কথাটা নাহয় বাদ’ই দিলাম। উপরোক্ত কোন একটি দৃশ্যও কিন্তু কাল্পনিক না,চরম সত্য।

নিজেদের প্রানের দাবি বাস্তবায়ন করতে ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে।শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তাদের সাথে রাস্তায় নামে আরেকটি মহল।যারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আন্দোলনকে বাধাগ্রস্থ ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে।কিছু কিছু প্ল্যাকার্ডে অমার্জিত ভাষায় প্রতিবাদ করতে দেখা যায়, যেগুলো সমালোচনার যোগ্য।আরেকটি মহল পাবলিক ও প্রাইভেট ভার্সিটির ছাত্রদের মধ্যে বিভেদ তৈরীর পাঁয়তারাও করে।কেউ কেউ এ আন্দোলনকে ঘিরে হাস্যকর অবস্থা সৃষ্টি করে আন্দোলনকে স্তিমিত করার অপচেষ্টা করেছে।

প্রতিটি আন্দোলনেই বাঁধা আসে, আগেও এসেছে,এটাই স্বাভাবিক।এতকিছুর পরও ছাত্ররা সফল হয়েছে এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি।এ আন্দোলনে ছাত্রসংগঠনগুলোও একাত্নতা ঘোষণা করে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।এ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ থাকার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যা অবশ্যই শিক্ষণীয়।অদূর ভবিষ্যতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিয়মবহির্ভূতভাবে টিওশন ফি বৃদ্ধির ব্যাপারে ছাত্ররা আপোষহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে আশা রাখি।মৌলিক অধিকার আদায়ে শিক্ষা ব্যবসায়ীদের আর কোন ছাড় নেই।

 

লেখকঃ

সাফাত জামিল শুভ
শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



মন্তব্য চালু নেই