ভূমিকম্প মোকাবিলার উপকরণই নেই চট্টগ্রামে!

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ভূমিকম্প মোকাবেলায় কোনো প্রস্তুতি নেই। আবহাওয়া অফিস থেকে শুরু করে ফায়ার সার্ভিস, গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, বিদ্যুৎ বিভাগ, হাসপাতাল, সিটি করপোরেশনসহ সরকারি-বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতেই নেই ভূমিকম্প মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় উপকরণ।

এসব বিভাগের সংশ্লিষ্টদের মতে, উপকরণের অভাবে দৈনন্দিন সমস্যা মোকাবেলায় যেখানে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মেকাবেলা! যত বড় দুর্যোগই হোক, যা আছে তা দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে।

পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন জানান, আবহাওয়া অফিসের কাজ হলো আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া। কিন্তু ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সতর্কবার্তা পাওয়ার মতো কোনো যন্ত্র বা প্রযুক্তি আবহাওয়া অফিসে নেই। আগাম সতর্কবার্তা পেলে মানুষ হয়তো জীবন রক্ষার চেষ্টা করতে পারে।

আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক জসিম উদ্দিন জানান, মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি দিয়ে চলছে ফায়ার সার্ভিস। কোনো উঁচু ভবন বা সাধারণ বড় অগ্নিকাণ্ডে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো কোনো যন্ত্র ফায়ার সার্ভিসে নেই। ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ মোকাবেলা প্রায় অসম্ভব।

জসিম উদ্দিন জানান, চট্টগ্রাম মহানগরে তিনটি ইউনিটে ২৪টি এবং উপজেলা পর্যায়ে ৭টি ইউনিটে ১৮টি গাড়িই অগ্নিনির্বাপণের একমাত্র সম্বল, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। লোকবল সংকট তো রয়েছেই।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চট্টগ্রামের সর্বত্র অপরিকল্পিত ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্যাস লাইনগুলো স্বাভাবিক অবস্থায়ও নগরবাসীর জন্য হুমকি। প্রতিদিন কোনো না কোনো লাইনে পাইপ ফেটে নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো সামলাতেই হিমশিম খেতে হয়।

ওই কর্মকর্তা বলেন, লোকবল সংকট, অনিয়ম-দুর্নীতি তো আছেই, আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহারে বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। গত ১৩ এপ্রিল ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে চট্টগ্রামের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্যাস লাইন বড় মাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে।

পিডিবির চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা আমিনুর রহমান জানান, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের শহর এলাকায় পুরো সরবরাহ লাইন ঝুঁকিপূর্ণ। দশ বছর আগে এই ঝুঁকির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। তা ছাড়া পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ওপর দিয়ে টানার কারণে যখন-তখন বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হচ্ছে।

আমিনুর রহমান বলেন, সাধারণ অবস্থায় যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন বিপজ্জনক, সেখানে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

উন্নত বিশ্বে মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুৎ লাইন টানার কথা উল্লেখ করে আমিনুর রহমান বলেন, এতে ভূমিকম্পের মতো প্রাকুতিক দুর্যোগেও নিরাপদ থাকে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। এখনেও এমনটি করার জন্য বছরের পর বছর প্রতিবেদন দিয়েও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক আবু মোহাম্মদ হানিফ বলেন, চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের অভাব নেই। অভাব শুধু ভালো চিকিৎসা আর শয্যার। স্বাভাবিক অবস্থায়ও যেখানে শয্যা খালি থাকে না; সেখানে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা কত কঠিন বলার অপেক্ষা রাখে না।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকৗশলী শফিউল আলম জানান, নাগরিক সমস্যা সমাধানে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার কাজে ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি যেখানে করপোরেশনে নেই, সেখানে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা কীভাবে সম্ভব। যা আছে তা দিয়েই মেকাবেলা করতে হবে সব দুর্যোগ।

এসব কর্মকর্তার মতে, বাংলাদেশে প্রতিরোধে যেমন কোনো পদক্ষেপ নেই, প্রতিষেধকেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে অন্তত এসব খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করে সেবার মাত্রা বাড়ানো যেত।

কর্মকর্তারা বলেন, দুর্যোগ মেকাবেলায় প্রথমত প্রয়োজন লোকবল, দ্বিতীয়ত প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার, তৃতীয়ত মনোভাব। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে আমাদের মনোভাবও অন্য রকম হয়ে গেছে। নিয়তির ওপরই ছেড়ে দিতে হচ্ছে ভাগ্য।

এদিকে গত এক বছরে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ঘটে যাওয়া একাধিক স্বল্প ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভূমিকম্প-ফোবিয়া তৈরি হয়েছে। অসুস্থতার কারণে কিংবা অবচেতনে হঠাৎ মাথা ঘুরছে বোধ করলেই মানুষ মনে করছে্- ভূমিকম্প হচ্ছে বুঝি।

মনের বাঘ বনে নামতে দেরি নেই বলছে বিবিসির খবর। সাম্প্রতিক এই খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ বড় মাত্রার ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে। যেকোনো সময় ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, বাংলাদেশের দুই দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। এর একটা হলো উত্তরপূর্ব কোণে সিলেট অঞ্চলে ডাউকি ফল্টে, আরেকটা চিটাগাং ত্রিপুরা বেল্টে পাহাড়ি অঞ্চলে।

১৩ এপ্রিল মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে চট্টগ্রামে ৯টি ভবন হেলে পড়ে। ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প যদি আঘাত হানে, চট্টগ্রামের ১ লাখ ৮৪ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবন ধসে পড়বে বলে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপণা মন্ত্রণালয়ের (সিডিএমপির) এক রিপোর্টে বলা হয়েছে।

এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পুরনো জরাজীর্ণ বাড়িঘর; অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণ; নিম্নমানের উপকরণে বহুতল ভবন; চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানসহ বেশ কটি শহর ও শহরতলীতে নির্বিচারে পাহাড় টিলা কেটে অথবা পুকুর-দীঘি ভরাটের মাধ্যমে বাড়িঘর ও ভবন নির্মাণ।

এসব কারণে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম মহানগরীসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে জানমালের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য যেসব জরুরি উদ্ধার সরঞ্জাম দরকার, সেগুলো হলো বুলডোজার, ফর্কলিফট, ট্রাক্টর, চেইনপুলি, পাওয়ার শোভেল, ব্রেকডাউন ভ্যান, প্রাইম মুভার, মোবাইল জেনারেটর, হেভি জ্যাক, ওয়েইটবল প্রভৃতি। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরীতে ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট উদ্ধারকারী সংস্থাগুলোর কাছে এ ধরনের সরঞ্জাম রয়েছে আংশিক। প্রশিক্ষিত জনবল খুবই অপ্রতুল।

বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ এ প্রসঙ্গে বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে অবস্থিত স্কুল বিশেষ করে কেজি স্কুল ভবনগুলো অত্যন্ত দুর্বল অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এসব ভবনে ঝুঁকির হার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। যদি দিনের বেলায় রিখটার স্কেরে ৭ বা তদূর্ধ্ব মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে চট্টগ্রামে কম-বেশি ৭০ শতাংশ স্কুল ধসে যাবে।

আলী আশরাফ বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে গড়ে ওঠা ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থাবিহীন ভবন বিশেষ করে স্কুল ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর কারিগরি নিয়মে শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এতে ভূমিকম্পে জানমালের ক্ষতির মাত্রা কমে আসবে।

সিডিএমপির বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, অগ্নিকাণ্ড, মাঝারি থেকে প্রবল ভূমিকম্প, ভূমিধসসহ যেকোনো দুর্যোগে চট্টগ্রাম মহানগরীতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসার লাইনে বিপর্যয়ের সম্ভাব্য প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নিরূপণের চেষ্টা চালানো হয় প্রথম দফায় পরিচালিত জরিপে।

এতে বলা হয়, এ ধরনের বিপর্যয় কিংবা দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, আনসার, সিটি করপোরেশন কিংবা পৌর কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত বিভাগের নানামুখী সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা বর্তমানে খুবই নাজুক পর্যায়ে রয়েছে। জরুরি উদ্ধার কাজের জন্য যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহ, প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলার জন্যও সুপারিশ করে সিডিএমপি।



মন্তব্য চালু নেই