ভূকম্পনের আভাস দেয় শিম্পাঞ্জি !

সেই কোন ভোরে, মন্দিরের চাতালে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ার ফাঁকে অকাতরে খুদ-কুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পুরোহিত। তারপর ডাক দিয়েছিলেন— পবিত্র পারোয়া আকাশ দেখিন ঝরদাইছ…(পবিত্র পায়রারা, আকাশ থেকে নেমে এসো)।

২৫ এপ্রিলের সেই সকালে সেই চেনা ডাকে কিন্তু সাড়া মেলেনি। পশুপতিনাথ মন্দিরের পাকাপোক্ত বাসিন্দা, হাজার কয়েক গোলা পায়রা সেদিন ভোর থেকে মেঘলা আকাশে অবিরাম চক্কর দিয়ে চলেছিল।

স্থানীয় বাসিন্দা চন্দ্রবাহাদুর শ্রেষ্ঠা জানাচ্ছেন, কী অস্থির হয়ে উড়ছিল পায়রাগুলো, মাটিতে নামলেই বুঝি কিছু একটা ঘটবে।

সকাল থেকে পশুপতিনাথ মন্দিরের খিলান-পাঁচিল-চাতালজুড়ে থাকে তাদেরও দখলদারি। লম্ফ-ঝম্প, ডিগবাজি, অনর্গল উচ্ছ্বলতা— সব ফেলে ওইদিন সকাল থেকে অদূরে খোলা মাঠে দল বেঁধে চুপ করে বসে ছিল বানরগুলো।

সাতদিনের নেপাল সফরে গিয়ে পশুপতিনাথ মন্দিরে বানরকুলের এই দুরন্তপনায় অভ্যস্ত এক ভারতীয় পর্যটক বলছেন, ‘ওই দিন সকালে মন্দিরের সামনে গিয়েই মনে হয়েছিল, পশুপতিনাথের চেনা চেহারাটা যেন হারিয়ে গেছে। পায়রার বকম বকম নেই, বানরগুলো কেমন চাপা উদ্বেগ নিয়ে গোল হয়ে বসে আছে। কী যেন একটা ঘটতে চলেছে!’ ভয়াবহ সেই ভূকম্পনের আগে কিছু কী আঁচ করেছিল তারা?

বিশিষ্ট ভূ-বিজ্ঞানী নারায়ণ দেশাই বলছেন, ‘আঁচ নিশ্চয় করেছিল। সে ক্ষমতা পশু-পাখিদের একাংশের রয়েছে।’ পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় চার দশক ধরে ভূকম্পন নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানাচ্ছেন, কম্পন অনুভবের এক বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে পায়রাদের।

বিশিষ্ট ভূ-বিজ্ঞানী জিম বার্জল্যান্ড তার ‘হোয়েন ইট হ্যাপেনস’ বইয়ে লিখছেন— ভূকম্পনের আগে মাটির গভীরে ইলেকট্রিক পাল্স অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় তৈরি হয় এক প্রকারের তরঙ্গ, পরিভাষায় যার নাম ‘টেলুরিক কারেন্ট’। মাটির উপরে স্পষ্টভাবে কম্পন অনুভুত হওয়ার বহু আগে সেই তরঙ্গের ছোঁয়ায় তৈরি হয় এক ধরনের অনুরণন। পায়রা সেই অনুরণন টের পায়। নারায়ণ বলছেন, ‘স্পর্ষকাতর পায়রারা তা টের পেয়েই হয়তো সেদিন অবিরাম উড়ে চলেছিল আকাশে, মাটিতে নামার সাহস পায়নি।’

শোনা যায়, ১৯৬৬ সালে চীনের শিংতাই প্রদেশে প্রলয়ঙ্কর ভূমিকম্পের আগে দিনভর আকাশে উড়েছিল পায়রা। ২০০১-এ গুজরাতের ভুজ কেঁপে ওঠার আগেও স্থানীয় বাসিন্দারা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন পায়রাদের এমন অস্থির ডানা ঝাপটানো দেখে।

প্রাণিজগতের এই অস্বাভাবিক ব্যবহারে বড় মাপের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আভাস মেলার খবর অবশ্য নতুন নয়।

চীনের ভূকম্পন প্রবণ হেইশেং, সোংপাস, নিঙশিয়ার প্রদেশের পুষ্যি গাধার ছড়াছড়ি। ভূ-বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ বলছে, কম্পনের কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই কান নামিয়ে মাথা নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে গাধা। ভূমিকম্পনের আগাম ইশারা পেতে তাই চীনের ওই সব এলাকায় গাধা পোষার বিশেষ চল রয়েছে।

১৯২০ সালে সে দেশের হাইউয়ান শহরে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের আগে রাতভর কেঁদেছিল রাস্তার কুকুররা। শহরের লাগোয়া জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে শহরের পথেঘাটে ছুটে বেরিয়েছিল লাগোয়া জঙ্গলের নেকড়ের দল। ১৯৭৪ সালে চীনের হেইশেঙে ভূকম্পনের মাত্রা রিখটার স্কেলে ছিল ৮.৪।

সেই বিপর্যয়েরও আভাস দিয়েছিল প্রাণিকুল। ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূকম্পন-বিশেষজ্ঞ কে টোরি জানান, কম্পনের মাস খানেক আগে থেকেই, ভরা ডিসেম্বরে চীনের ওই এলাকায় ঘন ঘন সাপ বেরোতে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দারা বুঝতেই পারেননি, টেলুরিক কারেন্টের অভিঘাতে মাটির অভ্যন্তর তপ্ত হয়ে ওঠায় শীত-ঘুম ভুলে বেরিয়ে এসেছিল সর্পকুল।

আর এই শহরে?

চিড়িয়াখানার অধিকর্তা কানাইলাল ঘোষ বলছেন, ‘২৫ এপ্রিলের সকালে তেমন খেয়াল করিনি। তবে ১২ মে কম্পনের আগে বাবুর (শিম্পাঞ্জি) সে কী চিৎকার, যেন পৃথিবী ভেঙে পড়তে চলেছে। কী আশ্চর্য, তার মিনিট পনেরোর মধ্যেই কেঁপে উঠল কলকাতা!’

তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার



মন্তব্য চালু নেই