ভালো বাসা’র তুলনায় ইলিশ যে বেশি ভালোবাসার!

কাঁচা কলার মালিশ খান৷ না হলে খান গাছ পাঁঠার মাংস৷ তাও না হলে, খান পাকা কুমড়ো বিচির ধোকা৷ তবে, এ সবও যদি পছন্দ না হয়, তা হলে খান কচি তালশাঁসের তরকারি৷

খান, ভালোবেসে খান! খান, ভালো বাসা খান৷ ভালোবাসায় খান! খান না, শোল মাছের মাংসী অথবা মাংস ভাজা কিংবা মাংসের হালুয়া! খান, হাঁসের ডিমের মোহন ভোগ৷ ভরপুর খান৷ আহা… বিশ্বের রান্না, বাংলায় খান না!

২০১৫-র অক্টোবরে কলকাতার বিভিন্ন অংশের হোর্ডিংয়ে শোভা পেয়েছিল, ‘খান, ভালো বাসা খান’৷ তবে, মাছ-ভাতের বাঙালির সকলের কাছেই যে ওই ভালো বাসা খাওয়ানোর আর্জি বোধগম্য হয়েছিল, তাও নয়৷ কেননা, প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকেরই এমন বিস্ময় ছিল যে, ভালো বাসা কীভাবে খাওয়া যায়!! কারণ, ভালো বাসা-র সঙ্গে তাঁরা ভালোবাসার ধন্দে পড়ে গিয়েছিলেন৷ কেউ কেউ আবার এমনও মনে করেছিলেন যে, বাসা মানে বাসস্থান৷ তা হলে, ভালো বাসা… অথচ খাওয়ানোর আর্জি…! কীভাবে এমন সম্ভব!

প্রাথমিক পর্যায় অতিবাহিত হওয়ার পরে অবশ্য মাছ-ভাতের ওই সব বাঙালির কাছে স্পষ্ট হয়েছিল যে, বাসা আসলে মাছের নাম৷ অর্থাৎ, ভালো বাসা মাছ খাওয়ানোর আর্জি ছিল ওই সব হোর্ডিংয়ে৷ তবে, এই ধরনের বিস্ময়ের মধ্যেই গত বছরের ৩১ অক্টোবর থেকে নভেম্বরের দুই তারিখ পর্যন্ত টার্কি রহস্য জমজমাট হয়ে উঠেছিল মিলনমেলা প্রাঙ্গণে! হবে না-ই-বা কেন!! উৎসব বলে কথা…! তার উপর, ওই উৎসব ছিল আবার পেটপুজোর৷ এবং, ওই উৎসবের পোশাকি নাম ছিল আহারে বাংলা৷ সর্বোপরি, পেটপুজোর এমন আয়োজন যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় বঙ্গীয় খাদ্য উৎসব ছিল! আহা রে বাংলা…!

যদিও, বিনামূল্যে নয়, আহারে বাংলায় ছিল ফেলো কড়ি মাখো তেলের ব্যবস্থা৷ তবুও, উৎসব-ই তো! আর, উৎসব হবে না-ই-বা কেন! বরং, উৎসব হবে৷ এবং, আরও বেশি করে হোক বিভিন্ন ধরনের উৎসব৷ আর, এই কারণেই, যে ধরনের উৎসব-ই হোক না কেন, সেই প্রসঙ্গে কোনও যুক্তি-তর্কের প্রবেশও বাঞ্ছনীয় নয়৷ কাজেই, মাছ-ভাতের বাঙালি খান, আরও বেশি করে ভালো বাসা খান! এবং, মাছ-ভাতের বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত মাছ কেনার সামর্থ্য নেই যাঁদের, তাঁরাও চেষ্টা করুন, যাতে নিয়মিত না হলেও মাঝে মাঝে পাতে রাখতে পারেন ভালো বাসা না হলেও সস্তার কোনও মাছের অন্তত এক টুকরো!

আহা রে… বাংলা…! ভরপুর পেটপুজোর আয়োজন হলেও, আহারে বাংলা তো আসলে উৎসব-ই ছিল! যে সে নয়, বঙ্গীয় খাদ্য উৎসব ছিল! যে কারণে, শুধুমাত্র ভালো বাসা খাওয়ানোর আর্জি ছিল না৷ শুধুমাত্র টার্কি রহস্য-ও ছিল না৷ এ সবের সঙ্গে ছিল বাংলা আহারের শতাব্দী প্রাচীন ১০৭টি পদ৷ যে সব পদের মধ্যে যেমন ছিল মাংস ভাজা, মাংসের তেলের বড়া, মাংসের ভাজা পুলি, মাংসের হালুয়া, পচামাছের রান্না, কাঁচা মাছের ঝাল, শোল মাছের মাংসী, ছেঁচা ফলি, হাঁসের ডিমের মোহন ভোগ, ডিমের স্নো বল, ডিমের কল কল৷ তেমনই ওই পদের তালিকায় ছিল কাঁচা কলার মালিশ, কাঁচা কলার গুলি কালিয়া, কাঁচা কলার খোসার ঘণ্ট৷ বেগুন খগিনা, বেগুনের চাটনি, বেগুনের বিরিঞ্চি এমনকী ছিল কচি তালশাঁসের তরকারি, গাছ পাঁঠার (এঁচড়) মাংস, বাঁধাকপির পায়েস, ফুলকপির ক্ষীর, পাকা কুমড়ো বিচির ধোকা-ও৷

কিন্তু, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গে দুই টাকার চাল যাঁরা কিনছেন, তাঁরা না হয় আহারে বাংলায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি৷ তাই বলে কি তাঁরা মাছের স্বাদ পাবেন না! আহা রে… বাংলা… আবার কেন যুক্তি-তর্ক!! ‘আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ বরং, উৎসব হোক হাজার হাজার বার৷ প্রয়োজনে, আরও বিভিন্ন ধরনের উৎসবের আয়োজন হোক৷ কলকাতায় যেমন জনপ্রতিনিধির উদ্যোগে ইলিশ মাছের উৎসবের আয়োজন হয়৷ তেমনই না হয় দুই টাকার চাল যাঁরা কেনেন, তাঁদের জন্যেও কোনও মাছের উৎসব হোক৷ কথায় আছে, শাকের রাজা পুঁই আর মাছের রাজা রুই৷ তবে, মাছ-ভাতের বাঙালির পাতে রুইয়ের থেকেও যে কত বেশি আদরের হয়ে রয়েছে ইলিশ, তা কী আর ahare-banner.04অস্বীকারের? যে কারণেও না এই বছর জামাইষষ্ঠীতে হাওড়ায় চার কেজি ওজনের একটি ইলিশ মাছের নিলাম হলে, ওই রুপালি ফসলটি বিক্রি হয়েছিল ২২ হাজার টাকায়!! ইলিশ অবশ্য বাংলাদেশের জাতীয় মাছ৷

কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গে মাছ-ভাতের যে সব বাঙালি দুই টাকার চাল কেনেন, তাঁদের সম্মান করেই বলছি, তাঁরা কি বছরে এক বেলা তাঁদের পাতে অন্তত এক টুকরো হলেও ইলিশ মাছ পেতে পারেন না? কেন পাবেন না!! বরং, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, যার জেরে বছরে অন্তত একবেলার জন্য হলেও দুই টাকার চালের সঙ্গে তাঁরা যেন বিনামূল্যে পেতে পারেন ইলিশ মাছ৷ সেই ইলিশ গঙ্গার অথবা পদ্মার কিংবা অন্য যে কোনও স্থানেরই হোক না কেন, বিনামূল্যে অন্তত এক বেলার জন্য পরিবারের সদস্য প্রতি এক টুকরো করে হলেও নিশ্চয় চলবে৷ কিন্তু, বছরের অন্য সব বেলার ক্ষেত্রে তা হলে কী হবে!! দুই টাকার চালের ভাতের সঙ্গে এক বেলা অন্তত এক টুকরো ইলিশের স্বাদ পাওয়ার পরে, অন্য বেলাগুলোর জন্যেও কি মন খারাপ হবে না!! যে কারণে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা কি উচিত নয়, যার জেরে দুই টাকার চালের মতোই মিলতে পারে সস্তার কোনও মাছ?

তবে, শুধুমাত্র দুই টাকার চালের ভাতের সঙ্গে সস্তার কোনও মাছের স্বাদ প্রদানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণও নয়৷ রাজ্য সরকার যদি ভর্তুকির মাধ্যমে দুই টাকার চালের সঙ্গে প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝে অনেক কম দামে কোনও মাছ দেওয়ার ব্যবস্থা করে, তা হলে অন্যদিকে আবার তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটব্যাংক-ও আরও পোক্ত হবে৷ কেননা, ভোটব্যাংক অটুট রাখার জন্য যথাযথ এবং সার্বিক উন্নয়নের তুলনায় ব্যক্তিস্বার্থের গ্রহণযোগ্যতা যে এখন অনেক বেশি! তবে, দুই টাকার চালের সঙ্গে না হলেও, ভর্তুকির মাধ্যমে সস্তায় ইলিশ মাছ বিক্রির জন্য রাজ্য সরকার যে চিন্তা-ভাবনা করেনি, তাও নয়৷ কিন্তু, ভর্তুকি দিয়ে অনেক কম দামে সাধারণ মানুষের জন্য ইলিশ মাছ বিক্রির বিষয়ে আলোচনা হলেও, এ ক্ষেত্রে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলেই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে৷ যদিও, সাধারণ মানুষের কাছে ইলিশ মাছ পৌঁছে দিতে এই রুপালি ফসল বিক্রি করতে শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গের মৎস্য উন্নয়ন নিগম৷ যে কারণে, রাজ্যের মৎস্য উন্নয়ন নিগমের স্থায়ী এবং ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ইলিশ মাছ কেনা যাচ্ছে৷ একই সঙ্গে এমনও প্রকাশ পেয়েছে যে, বেনফিস-ও এই ভাবে ইলিশ মাছ বিক্রি করবে৷

তবে, আরও বেশি ইলিশ মাছ যাতে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তার জন্য মৎস্য উন্নয়ন নিগম প্রচেষ্টা জারি রেখেছে বলেও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে৷ এই যখন পরিস্থিতি, তখন দুই টাকার চাল কেনার পাশাfish.04পাশি মাছ-ভাতের বাঙালির এই প্রত্যাশাও কি তৈরি হয় না যে, বছরে একদিন হলেও অনেক কম দামে মিলবে ইলিশ মাছের স্বাদ? স্বাভাবিক ভাবেই, ফেলো কড়ি মাখো তেলের মাধ্যমে শুধুমাত্র ভালো বাসা খাওয়ানোর আর্জি জানিয়ে উৎসবের আয়োজন নয়৷ কোনও জনপ্রতিনিধির উদ্যোগে শুধুমাত্র ইলিশ মাছের উৎসব নয়৷ শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের কাছে সরকারি তরফে আরও বেশি ইলিশ মাছ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণও নয়৷ বরং, তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটব্যাংক আরও পোক্ত করার জন্য, পশ্চিমবঙ্গের ‘পরিবর্তনে’র সরকারের বিভিন্ন ‘উন্নয়নে’র কর্মকাণ্ডের মতো দুই টাকার চালের সঙ্গে বছরে একদিন হলেও বিনামূল্যে ইলিশ মাছ দেওয়া হোক৷ বিনামূল্যে সম্ভব না হলে অনেক কম দামে দেওয়া হোক, যাতে দুই টাকার চালের মতো ওই ইলিশ মাছ-ও কেনা যায়৷ কিন্তু, কেন ইলিশ মাছ? কারণ, মাছের রাজা রুই এবং ভালো বাসা-র থেকেও যে মাছ-ভাতের বাঙালির কাছে অনেক বেশি আদরের… অনেক বেশি ভালোবাসার মাছের নাম ইলিশ!



মন্তব্য চালু নেই