‘ভালোবাসা চায় হিজড়ারা’

২০১৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে হিজড়ারা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে সরকারের স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু এই স্বীকৃতি তাদের অবস্থার পরিবর্তনে এখনো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেনি। নাগরিক হিসেবে হিজড়াদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় সেবা ও সুযোগে তাদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে ওই স্বীকৃতির যে আইনি রূপ দেওয়া দরকার ছিল, তা এখনো হয়নি।

বাংলাদেশের প্রায় সব আইন-কানুন, বিধি-বিধান, নীতিমালা এবং সরকারি-বেসরকারি সেবা ও সুযোগে নাগরিকদের লৈঙ্গিক পরিচয় নির্ধারিত হয় নারী অথবা পুরুষ হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে উত্তরাধিকার আইনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই আইন অনুসারে, শুধু একজন পুরুষ অথবা নারীই নিজেকে কারো উত্তরাধিকার হিসেবে দাবি করতে পারেন। একজন হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কথা এখানে উল্লেখ নেই। এর ফলে এ ধরনের মানুষদেরকে হরহামেশাই সম্পত্তির অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘটনা ঘটছে।

তাই এসব ক্ষেত্রে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গকে অন্তর্ভুক্ত করা না হলে, তাদের অধিকারের আইনগত ভিত্তি প্রশ্নের মুখে পড়ে। আর এই অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য কিছু কিছু আইন ও বিধি-বিধানের সংস্কার বা পরিবর্তন প্রয়োজন। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোস্তফা ইমাম হাসান লালন বলেন, ‘হিজড়াদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়, এর জন্য আইনগত সংস্কারও জরুরি।

এটা হতে পারে, বিদ্যমান আইনগুলোতে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নারী, পুরুষের পাশাপাশি হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটি যুক্ত করে তা সংশোধন করা, অথবা হিজড়াদের জন্য বিশেষ একটি আইন পাস করে তাদেরকে সব জায়গায় অন্তর্ভুক্তকরণের ব্যবস্থা করা।’ এর পাশাপাশি তিনি লিঙ্গীয় ও যৌন সংখ্যালঘু হিসেবে হিজড়ারা যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, সেটা রোধ করতে যত দ্রুত সম্ভব ‘বৈষম্য বিলোপ আইন’ তৈরির কথা বলেন।

হিজড়াদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তাদেরকে মূলধারায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হলো গণমাধ্যমে তাদের নেতিবাচক উপস্থাপন। বেশ কিছুদিন আগে একটি টেলিভিশন টক শোতে রাস্তা-ঘাট, দোকান ও বাসে হিজড়াদের টাকা সংগ্রহ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেই আলোচনায় টক শোর সঞ্চালক এই টাকা সংগ্রহকে ‘চাঁদাবাজি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং সেখানে উপস্থিত হিজড়াদের এক প্রতিনিধিকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে প্রশ্ন ও অভিযোগ করতে থাকেন।

গণমাধ্যমে হিজড়াদের এরকম উপস্থাপন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, হিজড়াদের অনেকেই টাকা তোলার কাজে যুক্ত। কিন্তু তারা কেন এই ধরনের একটি অসম্মানজনক কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, সেই প্রশ্নটিও সামনে আনা দরকার। গণমাধ্যমের উচিত, একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে হিজড়াদের যথেষ্ট সতর্ক ও সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করা এবং তাদের সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা।’

তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। এখনো বেশিরভাগ মানুষই তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন এবং তাদেরকে নানাভাবে হেয় করেন। বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে অফিস-আদালত কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনো জায়গাতেই তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয় না এবং তাদের প্রবেশাধিকারও সীমিত।

হিজড়া বলে মানুষ তাদের খারাপ চোখে দেখেন এবং ‘অস্পৃশ্য’ কিছু মনে করেন। সমাজে প্রচলিত এসব নেতিবাচক ধারণা নিয়ে আনোয়ারি নামে এক হিজড়ার আক্ষেপ, ‘আমরাও তো মানুষ। কোনো না কোনো বাবা-মা আমাদের জন্ম দিয়েছেন। তাহলে আমাদের প্রতি এত ঘৃণা কেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘শুধু কাগজে-কলমে সরকারি স্বীকৃতি নয়, আমরা অধিকার, সম্মান ও ভালোবাসা চাই।’-ইত্তেফাক



মন্তব্য চালু নেই