ভারতে যৌন ব্যবসার বেহাল অবস্থা, যৌনকর্মীদের দিন কিভাবে কাটছে জানলে অবাক হবেন

গত ৮ নভেম্বর যখন প্রধানমন্ত্রী দেশ থেকে পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের কথা ঘোষণা করেন, তখন তাঁর ঘোষণার মূল লক্ষ্য ছিল কালো টাকার ও জাল টাকার কারবারিরা। বড় অঙ্কের নোট বাতিল করে দেশে সঞ্চিত কালো টাকার ভাণ্ডারে তিনি আঘাত হানতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর পরিকল্পনায় কতটা সফল, তা বিচার করার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, মোদীর এই আকস্মিক সিদ্ধান্তের ফলে কেবল কালো টাকার মালিকরা নয়, নানাভাবে বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন রকম পেশার সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষ। সেরকমই বিপাকে পড়া কিছু মানুষ হলেন যৌনকর্মীরা।

দিল্লির যৌনপল্লি জি বি রোডে বসবাসরত যৌনকর্মীরা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের ফলে, সেই নিয়ে জাতীয় স্তরের মিডিয়ায় হইচই হয়েছে। ভাল নেই কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লি সোনাগাছির যৌনকর্মীরাও। মোদীর ঘোষণার পর থেকে ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে সোনাগাছিতে বসবাসরত মুন্নি, মেনকা, শেলিদেরও।

ঠিক কীভাবে নোট বাতিল আঘাত হেনেছে সোনাগাছির ব্যবসায়? সোনাগাছির বাসিন্দা সুপর্ণা জানালেন, ‘আসলে আমাদের ব্যবসা চলে মূলত নগদ টাকায়। আর গত ৮ নভেম্বরের পর থেকে তো মানুষের হাতে নগদ টাকারই অভাব। স্বভাবতই শরীরের খিদে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই মানুষের।’

সোনাগাছির দৈনিক রোজগারে ভাটা এসেছে অনেকটাই। ‘খদ্দের’-প্রতি ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা করে নিতেন সোনাগাছির যৌনকর্মীরা। বেশিরভাগ মানুষই যৌনকর্মীদের পারিশ্রমিক দিতেন ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোটে। কিন্তু ৮ নভেম্বরের পরে একদিকে সেইসব নোট বাতিল হয়ে গিয়েছে, অন্যদিকে হাতে থাকা খুচরো বা ১০০ টাকার নোট খরচ করতে চাইছেন না কেউই। ফলে সোনাগাছির রাস্তাই মাড়াতে চাইছেন না মানুষ।

সোনাগাছির এই দুর্দশা স্পষ্ট হয় এই এলাকায় একবার ঢুকলেই। আগে সন্ধ্যা হলেই জমে উঠত সোনাগাছির রাস্তাঘাট। কিন্তু এখন রাতের দিকেও শুনশান থাকছে সোনাগাছির অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট কিংবা জয় মিত্র স্ট্রিটের মতো রাস্তাগুলি। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা অঙ্গভঙ্গি ও কথার সাহায্যে পথচারীদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছেন যৌনকর্মীরা। অন্য সময়েও তেমনটা করে থাকেন, কিন্তু গত কয়েকদিনে পোশাক প্রদর্শনের বহর যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে তাঁদের ‘বুলি’র ধারও। সম্ভাব্য খদ্দেররা তার পরেও মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছেন।

শুধু যৌনকর্মীরা নন, দিন গুজরান কঠিন হয়েছে সোনাগাছিতে তৈরি হওয়া নানা উপজীবিকার সঙ্গে জড়িত মানুষদেরও। মদের দোকানে ভাটা, ফুলওয়ালাদের বিক্রিতে মন্দা, ‘চাট’ওয়ালাদের দোকান ফাঁকা— কার্যত অসময় ঘনিয়ে এসেছে সোনাগাছিতে।

সোনাগাছির সাত বছরের বাসিন্দা রুমপি জানাচ্ছে, ‘এম‌নিতেই আমরা যা রোজগার করি তার ৫০ শতাংশ যায় মাসির (যৌনকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করেন যে মহিলা) হাতে। বাড়িভাড়া বাবদ যায় আরও কিছু। যেটুকু টাকা আগে হাতে আসত, তা-ও এখন আর আসছে না।’

রুমপি, সুপর্ণাদের চিন্তা বাড়িয়েছেন এসকর্ট সার্ভিসের মেয়েরা। কারণ এই সব হাইফাই এসকর্ট সার্ভিসের মেয়েরা ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে নিজেদের পারিশ্রমিক নিচ্ছেন। নিচ্ছেন বাতিল ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটও। ফলে তাঁদের ব্যবসার এখন রমরমা। সোনাগাছির শেফালি তাই বলছেন, ‘কথায় বলে না, কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ! এ যেন ঠিক তাই। আমাদের ব্যবসা পড়ছে, আর এসকর্ট সার্ভিসের মেয়েদের ব্যবসা আরও জমে উঠছে।’

সুপর্ণার গলায় শোনা গেল আশঙ্কার সুর। তিনি জানালেন, ‘অবস্থা যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে ভয় হচ্ছে, আমাদের পারিশ্রমিক না কমাতে হয়।’ এমতাবস্থায় মোদীর সিদ্ধান্তকে কি সমর্থন করেন সুপর্ণা? কান্না-চাপা গলায় সুপর্ণা জানালেন, ‘মোদীজী যা করেছেন তাতে দেশের হয়তো সত্যিই ভাল হবে। কিন্তু আমাদের মতো মানুষের পেট কীভাবে চলবে, সেটা প্রধানমন্ত্রী একবার ভেবে দেখলে পারতেন। আসলে আমাদের কথা তো কেউই ভাবে না।’ সুপর্ণার গলায় স্পষ্ট ফুটে উঠছে অভিমান।



মন্তব্য চালু নেই