ভারতীয় চ্যানেল দেখে সন্তানরা মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে

ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ধারাবাহিকের কারণে দেশের যৌথ সংসারগুলো ভেঙে ছোট হয়ে যাচ্ছে এবং সন্তানরা মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে বলে দাবি করেছেন আইনজীবী।

সোমবার সংশ্লিষ্ট একটি মামলার রিটকারী আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া আদালতে শুনানির সময় এসব সিরিয়াল বন্ধ করারও দাবি জানান। অপরদিকে সিরায়াল বন্ধ হলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে বলে মনে করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

রিটকারীর পক্ষে আইনজীবী মো. একলাছ উদ্দিন ভূইয়া, রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহের হোসেন সাজু, স্টার জলসা, স্টার প্লাসের পক্ষে রুল শুনানিতে অংশ নেন প্রাক্তন আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু। অপরদিকে জি-বাংলার পক্ষে শুনানি করেনন ব্যারিস্টার সামসুল হাসান।

দুপুর সোয়া ২টায় শুনানিকালে উভয় পক্ষের প্রায় শতাধিক আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন। সোমবার শুনানি শেষে আগামী ২৫ জুনয়ারি পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন আদালত।

পঞ্চম দিনের শুনানির শুরুতে আইনজীবী আব্দুল মতিন খসরু বলেন, ‘আমি স্টার জলসা ও স্টার প্লাস টিভি চ্যানেল বাংলাদেশের পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠান ডিজি জাদু ব্রডব্যান্ড লিমিটেডের পক্ষে এসেছি। আমি সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে এসেছি। স্টার জলসা ও স্টার প্লাসে প্রদর্শিত সিরিয়ালে কোনো প্রকার অশ্লীল দৃশ্য প্রদর্শিত হয় না। সরকারি অনুমোদন নিয়ে এই ক্যাবল অপারেটরের মাধ্যমে বিদেশি ১৩টি টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে প্রদর্শন করা হয়।’

‘এসব সিরিয়াল প্রদর্শন করার কারণে সমাজের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না’ বলেও উল্লেখ করেন আব্দুল মতিন। তিনি বলেন, ‘বরং সমাজ ও সংসার জীবনের বাস্তব কিছু চিত্র এখানে মাত্র তুলে ধরা হয়। আমি ব্যক্তিস্বার্থে এসেছি। সরকারি সম্পূর্ণ নিয়মের মধ্য থেকে স্টার প্লাস ও স্টার জলসা প্রদর্শন করা হয়। এ বিষয়ে এর আগেও একটি রিট দায়ের করা হয়েছিল। তখন আদালত খারিজ করেছিল।’

আব্দুল মতিন খসরুর বক্তব্যের পাল্টা জবাব দেন রিটকারী আইনজীবী একলাছ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘মাই লর্ড, আমি এর আগে যে রিট করেছিলাম তা হাইকোর্ট উত্থাপিত হয়নি- মর্মে খারিজ হয়। তখন আদালত বিষয়টি অন্য আাদলতে আবেদন করার জন্য নথি দিয়ে অনুমোদন প্রদান করেন। যে কারণে অন্য বেঞ্চে পুনরায় আবেদন করার সুযোগ পাই। তাই আবার রিট করলাম। এতে কোনো আইনি ব্যত্যয় হয়নি।’

‘মাই লর্ড, ভারতীয় তিনটি টিভি চ্যানেল স্টার জলসা, স্টার প্লাস ও জি বাংলা এখনো দেশে অবৈধভাবে পরিচালনা করছে। কেননা ২০১৪ সালের পর থেকে তারা আর কোনো লাইসেন্স নবায়ন করেনি। এমনকি নবায়ন সংক্রান্ত কোনো নথি আদালতে দেখাতে পারেনি।’

রিটকারী আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, এ সমস্ত সিরিয়ালে আকৃষ্ট হয়ে সমাজ ও সংসার জীবনের কী পরিমাণ অবক্ষয় হচ্ছে- তা দেশের বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া উঠে এসেছে। এ সময় আইনজীবী দুটি টিভি চ্যানেলের প্রকাশিত নিউজ সিডি আকারে আদালতে উপস্থাপন করেন। ওইসব সিডির সংবাদ আদালত মাইক্রো প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেখানো হয়। ওই সব সংবাদে ভারতীয় সিরিয়ালের কারণে সংসার ও সমাজজীবনের বিভিন্ন অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরে বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরা হয়।

এরপর আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, মাননীয় আদালত পত্রিকায় দেখা যায়, ভারতীয় টিভি চ্যানেলে প্রদর্শিত ‘কিরণ মালা’ সিরিয়ালের কারণে সারাদেশে এ পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ‘পাখি’ সিরিয়ালের কারণে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে পত্রিকার একটি কলামে নাট্যকার মামুনুর রশিদ বলেছেন, দেশের ৮০ ভাগ বিয়ে ও সংসার বিচ্ছেদ ঘটছে শুধু ভারতীয় এসব সিরিয়ালের মাধ্যমে।

এ ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ এবং ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর আইনজীবীরা সমাজজীবনের অবক্ষয়ের বিপক্ষে কোনো যুক্তি তুলে ধরতে পারেননি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া, বউ-শাশুড়ির মধ্যে মনোমালিন্য এবং যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে ছোট হয়ে যাচ্ছে শুধু এসব সিরয়ালের প্রভাবে। একসময় একান্নবর্তী পরিবারের প্রথা ছিল এ দেশে। কিন্তু এখন পিতা-মাতার সঙ্গেও থাকতে চায় না সন্তানরা। বরং বউরা ছেলেকে নিয়ে পৃথক বাসায় থাকে। আর মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আবার অনেক ছেলেমেয়ে এসব সিরিয়ালের প্রভাবে পিতা-মাতাকে ভরণ-পোষণ না দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে। এসব কিছু বিভিন্ন পত্রিকায় উঠে এসেছে। শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্যও এসব সিরিয়াল অন্তরায়।

ক্যাবল টেলিভিশন পরিচালনা আইন ২০০৬-এর ৩, ৪, ৫, ৮, ৯, ১০ ও ১৯ ধারা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এসব চ্যানেলের সম্প্রচার সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া যাবে। এ আইনের ১৫ ও ২০ ধারার আলোকে এসব চ্যানেল বন্ধ করার সুযোগ রয়েছে। ৯ ও ১০ ধারা অনুযায়ী এসব চ্যানেল এসব ধারা লঙ্ঘন করেছে বলেও আদালতে উল্লেখ করেন আইনজীবী। তিনি বলেন, এ ছাড়া টিভি চ্যানেল প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আইনানুযায়ী দেশের সরকারি টিভি চ্যানেল থাকবে এক নম্বরে। এরপর দেশের টিভি চ্যানেলগুলো সরকারি অনুমোদনের তারিখ অনুযায়ী প্রদর্শনের তালিকায় থাকবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, দেশের টিভি তালিকায় আগে ভারতীয় অনেক টিভি চ্যানেল প্রদর্শিত হচ্ছে।

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানি শুরু করেন। শুরুতে তিনি বলেন, ‘মাই লর্ড আমি ও আমার স্ত্রী একসঙ্গে বসে এসব ভারতীয় সিরিয়াল দেখি। এসব সিরিয়ালে সংসার জীবন ও পরিবারের নানা সুবিধা ও আসুবিধার চিত্র তুলে ধরা হয়। এখানে আমি খারাপের কিছুই দেখি না। বরং বাংলাদেশের অনেক শিল্পী ভারতে যায় এবং ভারতীয় অনেক শিল্পী এ দেশে আসে। আমাদের দেশের অনেক সিরিয়াল ওই দেশে অনেক জনপ্রিয়। ভারতীয় এসব সিরিয়াল বন্ধ করলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হবে।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, এ ছাড়া বর্তমানে আকাশসংস্কৃতির যুগে এসব বন্ধ রাখা যাবে না। কেননা গুগল ও ইউটিউবের মাধ্যমে সবাই দেখার সুযোগ পাচ্ছে। এ কারণে বাধা দেওয়ারও কোনো পস্থা নেই। এসব টিভি চ্যানেল প্রদর্শন বন্ধ হলে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে পরিমাণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক, তা বিনষ্ট হবে।

অ্যাটর্নি জেনারেলের এ বক্তব্যেরও জবাব দেন রিটকারী আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, গুগল, ইউটিউব বন্ধ করার কোনো আইন নেই। কিন্তু এসব টিভি চ্যানেল অনিয়ম করে প্রদর্শন করলে বন্ধ করার সুযোগ আছে। দেশের শিশু ও সমাজজীবনের কথা চিন্তা করে এটি বন্ধ করে দেওয়া হোক।

এ পর্যায়ে আদালতের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় শুনানি ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জে বি এম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ভারতীয় টিভি চ্যানেল প্রর্দশন বন্ধ করতে রিটের পঞ্চম দিনের শুনানিকালে এসব কথা বলেন আইনজীবীরা।

২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে ভারতীয় এই তিন টিভি চ্যানেল বন্ধে নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ওই সময় বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।

রুলে তথ্যসচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ টেলি যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়।

এর আগে ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা শাহীন আরা লাইলি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই রিট দায়ের করেন। এতে ভারতীয় সব চ্যানেল বন্ধে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারির আবেদন করা হয়।



মন্তব্য চালু নেই