‘ভল্ট মাস্টারের সাড়ে তিন ঘণ্টার মিশন’

ব্যাংকের ভল্ট বা সিন্দুক ভাঙতে রাজা মিয়ার সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ মিনিট। এ ‘যোগ্যতার’ কারণে সহযোগীরা তাকে ভল্ট মাস্টার বলেও ডাকে। ব্যাংক চুরি বা ডাকাতি যাই করা হোক রাজাকে প্রয়োজন হয়ই! বড় একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য এই রাজার পরিকল্পনায়ই গত ২৬ সেপ্টেম্বর জয়পুরহাটের ব্র্যাক ব্যাংক থেকে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকা লুট হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে প্রস্তুতি চললেও ঘটনার রাতে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায়ই শেষ হয় সেই চুরির মিশন। আর ওই অপকর্মে অংশ নিয়েছে মোট নয়জন। চুরির টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় তারা।

জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও পুরনো ‘দক্ষতা’ কাজে লাগায় রাজা। ভল্টের ‘দক্ষতা প্রয়োগের’ কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা আছে আরও চারটি। অন্যতম সহযোগী শামীমের সঙ্গে কারাগারেই সখ্য হয় রাজার। দু’জনে জয়পুরহাটে ব্র্যাক ব্যাংকের পাশে ‘বাংলাদেশ পুওর ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড’ নামে একটি ভুয়া এনজিরও অফিস ভাড়া নিয়ে ব্যাংকে লুটের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। চাঞ্চল্যকর এ ব্যাংক লুটের ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার এবং ৫৬ লাখ টাকা উদ্ধারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, মূল পরিকল্পনাকারী রাজা মিয়া চট্টগ্রামের ব্যাংক ডাকাত শুক্কুর গ্রুপের সদস্য। ২০০৮ সালে রাজধানীর ধানমন্ডির ব্র্যাক ব্যাংকের কলাবাগান শাখা থেকে ২৫০ ভরি স্বর্ণালংকার লুটের সঙ্গে জড়িত ছিল সে। জামিনে ছাড়া পেয়ে শামীমসহ অন্যদের নিয়ে জয়পুরহাটে আবার হানা দিয়েছে ভল্ট আনলক স্পেশালিস্ট রাজা মিয়া। তাদের গ্রুপের পলাতক দুই সদস্য ইসলাম ও তাজ আহমেদকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তারা।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ধানমন্ডির ২৫০ ভরি স্বর্ণালংকার লুটের সঙ্গে জড়িত রাজাই জয়পুরহাটে ব্যাংক লুটের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী। কারাগারে থাকার সময় শামীমের সঙ্গে রাজার পরিচয় ও সম্পর্ক হয়। এরপর তারা পরিকল্পনা করে ঘটনাটি ঘটায়। তাজ ও নওশের ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে সিসিটিভি ক্যামেরা নষ্ট করে দেয়। এরপর ইসলাম ও রাজা মিয়া সেখানে প্রবেশ করে। চারজন ব্যাংক থেকে টাকা সংগ্রহ করেছিল।

আটক স্বপন দেবনাথ ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে সাধারণ আনসার সদস্য হিসেবে কাজ করতেন। চুক্তির মেয়াদ শেষে তিনি রাজা ও শামিমের সঙ্গে ব্যাংক লুটেরা সিন্ডিকেটে জড়িত পড়েন।

জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা আরও জানান, রাজা একজন ভল্ট আনলক স্পেশালিস্ট। যে কোন ধরনের ভল্ট বা সিন্দুকের তালা সে ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে ভাঙার যোগ্যতা রাখে। যার ফলে এ ধরনের ডাকাতির পরিকল্পনায় রাজা একজন অনিবার্য সদস্য। সহযোগীরা তাকে ‘ভল্ট মাস্টার’ বলে ডাকে। জয়পুরহাট থেকে লুট হওয়া টাকা হতে রাজা ৩১ লাখ, শামীম ৩৩ লাখ, ইসলাম ১২ লাখ ৫০ হাজার, তাজ মাহমুদ ৮ লাখ, এমকে কুদ্দুসুর রহমান বুলু ও ইকবাল ৩৩ লাখ, স্বপন ১৮ লাখ, নওশের ১৪ লাখ ও বাদল নয় লাখ করে ভাগ করে নিয়েছে।

বুধবার রাত ১১টার দিকে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার হাশারপাড়া এলাকা থেকে নসকরপুর গ্রামের ভোলা মিয়ার ছেলে রাজাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বরিশালের মোনসা বাড়ির রতনের ছেলে বাবলা ও স্বর্ণা গ্রামের মোজাফফর আহম্মেদের ছেলে শামীমকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা স্টেডিয়ামের পাশে থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর বুধবার মধ্যরাতে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকা থেকে ময়মনসিংহের ফুলপুরের শালিয়া গ্রামের ইন্দ্রজিত চন্দ্র পণ্ডিতের ছেলে প্লাবন ও অনুপকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। রাতের শেষভাগে ময়মনসিংহের ফুলপুরেরর বাউলা গ্রাম থেকে গৌরীপুরের দত্তবাড়ীর মনু দেবনাথের ছেলে স্বপনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। সবশেষ ফতুল্লা থেকে বরিশালের কাউনিয়ার মৃত ইয়াকুব আলীর ছেলে বুলুকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, রাজা মিয়া ২০০৮ সালে চট্টগ্রামের শুক্কুরের নেতৃত্বে ঢাকার ব্র্যাক ব্যাংকের কলাবাগান শাখায় শাহেদ আলম, হানিফ ও অন্যান্য ২০/২১ জনের সহায়তায় ২৫০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে। ঘটনার পর রাজা মিয়া গ্রেপ্তার হয়ে দেড় বছর কারাভোগ করে। কারাগারে থাকাকালীন রাজধানীর বাড্ডার চুরি মামলার আসামি শামীমের সঙ্গে রাজা মিয়ার পরিচয় হয়। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর ২০১২ সালে শামীমের সঙ্গে রাজা মিয়ার দেখা হয়। তখন তারা ভবিষ্যতে এক সঙ্গে ‘বড় কোন কাজ’ করার ইচ্ছাও করেছিল। গত ১ আগস্ট রাজাকে ফোন করে শামিম বলে ‘একটা বড় কাজ আছে’- করবি? রাজা রাজি হয়ে যায়। এরপর থেকে তারা নিজেদের লোকদের সংগঠিত করতে থাকে। ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা থাকলেও গত ১৮, ১৯, ২১ সেপ্টেম্বর বিএনপি জামায়াতের দেশব্যাপী ডাকা হরতালে তারা কিছুসময় নীরব ছিল। গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ জয়পুরহাটে ব্যাংকের পাশে ‘বাংলাদেশ পুওর ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড’ নামে একটি এনজিও-এর অফিসের নাম করে ভাড়া নেয় নেয় তারা। বুলুকে এ দায়িত্ব দেয় শামীম। ঘর ভাড়া নিয়ে চাবি ইসলামকে বুঝিয়ে দেয়। ঘটনার ১০/১৫দিন আগে রাজা মিয়া তার পূর্ব পরিচিত স্বপনকে দেয়াল কাটার লোক নিয়ে আসতে বলে। স্বপন দেবনাথের সঙ্গে রাজা মিয়ার পরিচয় আহমেদবাগ বৌদ্ধ মন্দির এলাকায় একটি চায়ের দোকানে ২/৩ বছর আগে। ওই পরিচয়ের সূত্র ধরে মোবাইলে রাজা মিয়ার সঙ্গে এই ডাকাতির ব্যাপারে যোগাযোগ হয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়- স্বপন, তাজ, নওশের দেয়াল কাটার কাজ করতে জয়পুরহাটে যায়। ডাকাতির প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে ইসলাম, তাজ স্ক্রু ড্রাইভার ও শাবল দিয়ে দেয়াল কাটার কাজ শুরু করে এবং এই কাজ সম্পন্ন করতে ছয়দিন সময় লাগে। দেয়াল কাটার পর ব্র্যাক ব্যাংকে প্রবেশ করার মতো সুড়ঙ্গ তৈরি করে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে শুরু হয় চূড়ান্ত মিশন। রাত ১১টার দিকে তারা দেয়াল ফুটো করার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এরপর তাজ মাহমুদ ও নওশের ব্যাংকে প্রবেশ করে সিসি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে এবং তার কিছুক্ষণ পরই রাজা মিয়া ও ইসলাম আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নিয়ে ভল্টে প্রবেশ করে। এরপর তারা ভল্টের তালা ভাঙে। ভল্টের তালা ভাঙার পর তারা টাকা কয়েকটি ব্যাগে ভরে এবং ভাড়া করা রুমে নিয়ে যায়। লুটের সময় তারা ১০০ বা ৫০ টাকার কোন নোটের বান্ডিল নেয়নি। শুধু ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট নেয়। পাঁচজন পাশের একটি গেস্টহাউসে থেকে চারজনের সঙ্গে ফোনে যোগায়োগ রাখছিলেন। পরবর্তীতে লুট করা টাকা পার্শ্ববর্তী ঘরে ভাগাভাগি করে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ছিল রাত আড়াইটা। অর্থাৎ- ভেতরে ঢোকা থেকে শুরু করে শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় লেগেছে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা।

বৃহস্পতিবার র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন ব্র্যাংক ব্যাংকের হেড অব রিক্স ম্যানেজমেন্ট সৈয়দ ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকের নিরাপত্তার কোন ঘাটতি ছিল না। তবে সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়ায় আমরা ক্লু পাইনি। এটা অনেক সময় নিয়ে ওরা করেছে। একজন তো শুনছি নাকি মাস্টার। আশা করি তারা বাকি টাকাগুলোও উদ্ধার করে দিতে পারবে র‌্যাব।’

এদিকে র‌্যাব ও পুলিশের সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের ৫ জানুয়ারি ধানমন্ডিতে মিরপুর রোডে হোটেল নীদমহলের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ব্র্যাক ব্যাংকের ছাদ কেটে ভেতরে ঢুকে চোররা ৭৫টি লকার ও ৬২টি ভল্ট থেকে স্বর্ণালংকার ও টাকা লুট করে রাজাসহ কয়েকজন। ঘটনার তদন্তে নেমে ডিবি পুলিশ রাজা মিয়া, সাহেব আলমসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। বেরিয়ে আসে- এ চক্রে অন্তত ২৫ জন জড়িত। তবে লুটেরা চক্রটির সব সদস্যকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। গ্রেপ্তারকৃত চারজনও পরে জামিনে মুক্ত হয়েছে। সূত্রমতে, রাজার বিরুদ্ধে ধানমন্ডির ওই মামলা ছাড়াও ব্যাংক ও মার্কেটে চুরির আরও তিনটি মামলা আছে।

তবে রাজা মিয়া দাবি করেন, ভল্ট ভাঙার জন্য ৫০ হাজার টাকায় তাকে চুক্তিবদ্ধ করেছিল শামীম। পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত নয় সে। অন্যদিকে শামীমের দাবি, তিনি এমএলএম মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তিনি ব্যাংকের লুটের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত নন।

প্রসঙ্গত- সর্বশেষ ২৬ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) দিবাগত রাতের কোনো এক সময় জয়পুরহাট-বগুড়া সড়ক সংলগ্ন বাটার মোড়ের শাজাহান ম্যানসনের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ব্র্যাক ব্যাংকের দেয়াল কেটে টাকা লুটের ঘটনাটি ঘটে। গত জানুয়ারি মাসেও কিশোরগঞ্জের সোনালী ব্যাংকে সিঁদ কেটে চুরির ঘটনা ঘটেছিল।



মন্তব্য চালু নেই