ব্যাকটেরিয়া: নিজেই নির্বংশ হচ্ছেন নীরবে!

জ্বি, আপনাকেই বলছি! আপনি নির্বংশ হচ্ছেন নীরবে এবং খুব দ্রুত! কথাটা আপনার কানে লাগতে পারে; কিন্তু কথাটা শতভাগ সত্যি, এতে কোন সন্দেহ নেই।

ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই, তাহলেই বুঝতে পারবেন। এই ৫/৬ বছর আগের কথাই ধরুন, মাঝে মাঝে হাল্কা জ্বর জ্বর ভাব আর গলা ব্যথা আমাদের অনেকেরই হত। চট করে ফার্মাসী থেকে এজিথ ট্যাবলেট, ৫০০ মি গ্রা এর ১ টা করে পর পর তিন দিনে ৩ টা খেয়ে ফেলতেন অনেকেই। বেশিরভাগই এতে ভাল বোধ করতেন।

বছর ঘুরতে না ঘুরতে দেখা গেল, এখন আর ৩ দিনে কাজ হচ্ছে না। পর পর ৫ দিন খেতে হচ্ছে ১ টা করে।

এখন অনেকে ৭ দিনে ৭ টাও খাচ্ছেন, কিন্তু এতে আর আগের মত কাজ হচ্ছে না।

মাত্র ৫/৬ বছরের মাথায় একটা এন্টিবায়োটিক আপনার একই অসুখে আর কাজ করছে না! এভাবে চিন্তা করে দেখুন, প্রতিদিন কতগুলো এন্টিবায়োটিক আপনার বা আপনার কাছের কারো না কারো জন্য অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে!!

মূলত আপনার জন্য অকার্যকর হচ্ছে না, আপনি যে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে অকার্যকর হয়ে উঠছে। আর এই ব্যাকটেরিয়া কিন্তু রোগ সৃষ্টি করার সময় কাউকে ছাড় দেবেনা, এমনকি আপনার এক দিনের শিশু বা বৃদ্ধ বাবা-মাকেও না! বরং তাদের ক্ষেত্রে অবস্থা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে!!

আর এভাবেই নীরবে নিভৃতে নিজে নির্বংশ হতে চলেছেন, ব্যাকটেরিয়াকে নির্বংশ করতে গিয়ে!!

পেনিসিলিন ও একটি দ্বিমূখী যুদ্ধ!

wp-1459089675347

১৯২৮ সালে স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং যেদিন পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন, সেদিন থেকে একটা দ্বিমূখী যুদ্ধের অবতারনা হয়।

১. আমাদের যুদ্ধ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে, এন্টিবায়োটিকের সহায়তায়।
২. ব্যাকটেরিয়ার যুদ্ধ এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে, প্রাকৃতিকভাবে এবং আমাদের সহায়তায়(!!)

এই দ্বিমুখী যুদ্ধে অনেক দিন আমরা এগিয়ে ছিলাম। কারন যতই দিন গিয়েছে আমরা নতুন নতুন এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেছি। কিন্তু ব্যাকটেরিয়াও লড়ে গেছে সমান তালে। তাদের জেনেটিক কোডের নানারূপ পরিবর্তন এনে আস্তে আস্তে মুটামুটি সব এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছে কার্যকর আত্মরক্ষা ব্যবস্থা!

ফলস্বরূপ আমরা এই যুদ্ধে পিছিয়ে পড়ছি ক্রমাগত। এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের তুলনায় নতুন এন্টিবায়োটিক উদ্ভাবনের হার কমে গেছে, বেড়ে গেছে রিসার্চের জন্য খরচও। সাথে আমাদের মধ্যকার কারো কারো জানা-অজানায় করা বিশ্বাসঘাতকতাও এজন্যে দায়ী!

কেন এই এন্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা??

যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে আক্রমনের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার আছে, আক্রমনের তীব্রতায় কখনো ছাড় দিতে নেই। ছাড় দিলেই প্রতিপক্ষ পুন:সংগঠিত হয়ে যায়, পুন:আক্রমন করে নতুন উদ্যমে।

ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রেও এই সুত্র খাটে। সব এন্টিবায়োটিকেরই ডোজের মাত্রা, খাবার সময়ের মধ্যকার ব্যবধান ও কতদিন খেতে হবে, এগুলো ঠিক করা হয় অনেক ক্লিনিক্যাল স্টাডির উপর ভিত্তি করে।

কোন ঔষধ রক্তে থাকে ১২ ঘন্টা, কোনটা ৮ ঘন্টা আর কোন কোনটা ২৪ ঘন্টা অবধি। এর উপর ভিত্তি করে ডোজের মধ্যকার সময় পার্থক্য বা ডোজ ফ্রিকোয়েন্সি নির্ধারন করা হয়। কারন, রক্তে একটি নির্ধারিত পরিমান ঔষধ নির্ধারিত সময় ধরে না থাকলে ব্যাকটেরিয়ার সাথে যুদ্ধে ভাটা পড়ে, তারাও তখন রিট্রিট করার সুযোগ পায়, জেনেটিক কোড পরিবর্তন করতে থাকে এবং আস্তে আস্তে সেই এন্টিবায়োটিকে নিজে তো মরেই না, বরং ঐ ঔষধকে হজম করে ফেলে!!
এরপর সেই ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন মাধ্যমের সহায়তায় প্রকৃতিতে আসে এবং অন্যদের আক্রমন করে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম একই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে আরো শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা!!

একই ঘটনা ঘটে যদি প্রয়োজনীয় সময় পর্যন্ত আপনি এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করেন। যেমন, একটি এন্টিবায়োটিক দৈনিক ৮ ঘন্টা পর পর পর পর ৭ দিন খেতে হয়। কিন্তু আপনি দুই দিন খেয়ে ভাল বোধ করছেন বলে আর খেলেন না! ব্যাকটেরিয়া যা ইনজুরড হয়েছিল দুই দিনে, তারা আবার নিজেরদের জেনেটিক কোড পরিবর্তন করা শুরু করে দেবে, আরো শক্তিশালী হবে। দেখবেন দুই দিন পর আপনার আবার পুরাতন উপসর্গগুলো ফিরে এসেছে এবং আরো প্রবলভাবে!

wp-1459089770330

একই ঘটনা ঘটবে যদি দুইদিন খেয়ে আর একদিন না খেয়ে পরদিন আবার খান, অথবা পুরো ৭/১০ দিন(চিকিৎসক যে কয়দিন বলেছেন) না খেয়ে আগে আগে বন্ধ করে দেন।

এরকম এন্টিবায়োটিক অকার্যকারিতার আরেকটি কারন হল, যে রোগের জন্য যে এন্টিবায়োটিক, সে রোগে সেটি ব্যবহার না করে অন্য এন্টিবায়োটিক খেলে। এতে বিপদ উভমূখী! একদিকে যেমন ঐ অন্য রোগের ঔষধটি অকার্যকর হয়ে পড়ে, তেমনি আপনার বর্তমান রোগের জীবানুও শক্তিশালী হয়।

এভাবেই ব্যাকটেরিয়া আমাদের সহায়তায়(!!) দিন দিন আমাদেরই বিরুদ্ধে শক্তিশালী হচ্ছে!

আশা করি এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটি আপনাদের বোঝাতে পেরেছি।

মূল কালপ্রিট কে??

এটাই এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর প্রশ্ন।

উত্তরটা আমি এক কথায় দিচ্ছি, আমরা সবাই এর জন্য দায়ী! রোগী-রোগীর স্বজন-মাছ চাষী-হাসমুরগী ও পশুর খামারী-চিকিৎসার সাথে জড়িত ডাক্তার, স্যাকমো, ফার্মাসিস্ট, ফার্মাসী দোকানদার, ঔষধ কোম্পানী, সবাই।

এবার বিস্তারিত বলছি।

১. রোগী : প্রথম আসামী রোগী নিজে! রোগ হলে নিজে নিজে ডাক্তারী করে, নিজের মন মত ঔষধ কিনে খায়, এলোমেলো ডোজে এলোমেলো এন্টিবায়োটিক খায়। এরপর ডাক্তার যেভাবে বলেন, সেভাবে খায় না, টাকা খরচের ভয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেয় না। অনেকে আছেন টাকা বাচানোর জন্য ভাল কোম্পানীর ঔষধও কেনেন না!

২. রোগীর স্বজন : কবিদের ক্ষেত্রে এদেশে একটা বহুল প্রচলিত কথা হল, “দেশে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশী!” আর বর্তমানে বাস্তবতা হল, “বাংলাদেশে সবাই ডাক্তার!”

একটু লক্ষ্য করলেই এটা টের পাবেন। আসে পাশের কাউকে বলুন আপনার কয়েকদিন ধরে জ্বর-কাশি, দেখবেন শখানেক ফ্রি এডভাইস পেয়ে গেছেন, ঔষধও বলে দেবে। কিন্তু একটি প্রবাদ চিকিৎসার ক্ষেত্রে কখনোই ভুলবেন না যেন, “অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী!”

যে যেই বিষয়ে জানেন না, সে বিষয়ে তার পরামর্শ নেওয়াটা কতটা যৌক্তিক হতে পারে আপনিই বলুন।

আমি জানিনা কিভাবে বিল্ডিং বানাতে হয়, আপনি কি আমাকে দিয়ে আপনার বাড়ির ডিজাইন করাতে রাজি হবেন? যদি একটা বাড়ি ডিজাইন করাতেই রাজি না হন যার তার কথায়, তাহলে নিজের স্বাস্থ্যের চিকিৎসায় যার তার পরামর্শ নেওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?? আশা করি সমস্যাটা ধরতে পেরেছেন।

৩. মাছচাষী-হাসমুরগী ও পশুর খামারী : অবাক হবার কিছু নেই। নির্মম সত্য হল, আপনাকে নির্বংশ করতে উনারা সবাই অনেক বড় ভূমিকা পালন করছেন! তারা বিভিন্ন সময়ে তাদের চাষকৃত প্রানীগুলোর বিভিন্ন রোগ ঠেকাতে সেগুলোর ওপর বিভিন্ন প্রকার এন্টিবায়োটিক উচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করেন। আমার কাছে সরকারী হাসপাতালে কৃষক এসেছেন মেট্রোনিডাজল ও টেট্রাসাইক্লিন নিতে গরুকে খাওয়াবেন বলে!! তিনি জানেন না কি মাত্রায় গরুকে খাওয়াতে হবে, কিন্তু নিতে এসেছেন! বিশ্বাস না হলেও এটাই বাংলাদেশের কঠিন বাস্তবতা!!

তারা এই এন্টিবায়োটিক যখন ভুল মাত্রায় ভুল সময় ধরে পশুকে খাওয়ান, তখন একসাথে কয়েকটা ঘটনা ঘটে :

ক। পশুকে আক্রমনকারী ব্যাকটেরিয়া এন্টিয়াবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠে।

খ। পশুর প্রশ্রাব-পায়খানার মাধ্যমে প্রকৃতিতে আসা এন্টিবায়োটিক পরিবেশে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোকে সুযোগ করে দেয় এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠতে! সেই সাথে এই এন্টিবায়োটিক অনুগুলো মাটি থেকে গাছে চলে যায়, ফসল-ফলের মাধ্যমে মানবদেহে ঢুকে পড়ে। যেহেতু যথার্থ মাত্রায় মানবদেহে ঢুকে না, তখন সেগুলোর বিরুদ্ধে শরীরে থাকা সাধারন ব্যাকটেরিয়াগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং রোগ সৃষ্টি করে, যেগুলো আর এন্টিবায়োটিক দিয়ে সহজে সারতে চায় না!

গ। মাছ-মাংশের মাধ্যমেও কিছু মাত্রার এন্টিবায়োটিক মানবদেহে ঢুকছে, যেগুলো একই রকমভাবে মানুষের দেহে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরী করছে!

বুঝতে কি পারছেন, কে কোথা থেকে কিভাবে আপনার কতবড় সর্বনাশ করছে??

wp-1459089808611

৪. চিকিৎসক : চিকিৎসকবৃন্দও অনেক ক্ষেত্রে এই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের জন্য দায়ী। কেন, কিভাবে দায়ী সেটা হল,

ক। রোগগুলোর জন্য প্রপার এস্টাব্লিশড এন্টিবায়োটিক রেসপন্স সার্ভে নেই আমাদের দেশে এখনো। তাই সবাই যার যার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে বাধ্য হন। এক্ষেত্রে জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে কালচার ও সেনসিটিভিটি দেখা যায়। কিন্তু অনেক রোগীই এই খরচ নিতে চায় না! অগত্যা অভিজ্ঞতাই সম্বল।

খ। রোগীদের দ্রুত সুস্থ হবার মনোভাব এবং চিকিৎসকের রোগীর সন্তুষ্টির চেষ্টা। অনেক রোগীই আছেন এক/দুই ডোজ ঔষধ খেয়ে ভাল হয়ে যেতে চান। অনেকে আছেন, চিকিৎসক যদি এন্টিবায়োটিক না দেন, চিকিৎসাই নিতে চান না। তাই এরকম অনেক ক্ষেত্রেই অনেক চিকিৎসক এডভান্সড একটা এন্টিবায়োটিক দিয়ে দেন!

গ। বদ অভ্যাস! এন্টিবায়োটিক অপব্যবহারের বদ অভ্যাস আছে আমাদের কিছু চিকিৎসকের। বিনা প্রয়োজনেই দেন। এর পেছনে কিছু চিকিৎসকের ব্যক্তিগত সুবিধালাভের আকাঙখাও থাকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তবে সত্যি বলছি, এদের সংখ্যা মোটের ওপর খুবই অল্প। আমার ৭ বছরের চিকিৎসক জীবনে আমি এরকম একজনই পেয়েছিলাম।

৫. চিকিৎসক ব্যতীত চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িত অন্যরা : এদের মধ্যে আছেন স্যাকমো, মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট, নার্স, ফ্যামিলি ওয়েল্ফেয়ার ভিজিটর; অতিসম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারগণ।
উপরে উল্লিখিত কারোই এন্টিবায়োটিক সম্পর্কে ভাল কোন ধারনা নেই বললেই চলে। স্যাকমোরা যদিও খুব কমন কিছু এন্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করার ক্ষমতা রাখেন, বাকিরা সেটাও রাখেন না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা এগুলো দিচ্ছেন। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের মাধ্যমে এন্টিবায়োটিক ডিস্ট্রিবিউশন স্ট্র‍্যাটেজী আমি বলব আমাদের স্বাস্থ্য নীতি নির্ধারকদের একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই ম্যানপাওয়ারের কেউই মেডিকেল ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক নয়, জেনারেল লাইনের লোক। আমরা জেনেশুনে এদের হাতে এটম বোমা দিয়ে দিয়েছি। ফিল্ড লেভেলে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা হল, এদের মাধ্যমে এন্টিবায়োটিক মিস ইউজ হচ্ছে। সি এইচ সি পিরা কোন এন্টিবায়োটিক কোন রোগে দিতে হবে, সে ব্যাপারে পুরোপুরি ক্লিয়ার না যেমন, তেমনি তারা সেগুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও ভাল জানেন না। অবশ্য স্থানীয়ভাবে আমরা কিছু কাজ করছি তাদের এসব বিষয়ে শেখানোর জন্য এবং চেষ্টা করছি যথাযথ মনিটরিং এর, যাতে অন্তত এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে ভুল কমে আসে।

৬. ফার্মাসীর দোকানদার : এরা হল আমাদের আসন্ন বিপদের জন্য সবচেয়ে বড় কালপ্রিট। এরা আমাদের দেশের মানুষের বন্ধু সেজে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করছে। কিভাবে করছে বলছি। তার আগে এটা জানুন যে, আপনার এলাকার কতজন ফার্মাসী দোকানদার সরকার অনুমোদিত ফার্মাসিস্ট ডিপ্লোমা বা ন্যূনতম পেশাগত কোর্স করে এরপর ফার্মাসী চালাচ্ছেন! কতজনের সরকার অনুমোদিত ফার্মাসি কাউন্সিলের সনদ রয়েছে! আমার চাকুরী এলাকায় মাত্র একজনের এই যোগ্যতা রয়েছে, তাও তিনি আগে সরকারী চাকুরী করতেন, এখন রিটায়ার করেছেন বলে। বাকি কারোরই মানসম্মত ন্যূনতম কোন কোর্স করা নেই। সবাই এর সাথে ওর সাথে থেকে ঔষধ চেনে, এই ডাক্তারের কম্পাউন্ডার ছিল, এভাবে এই যোগ্যতা(!!) দিয়ে ফার্মাসী খুলে বসে আছে।

আর আমাদের দেশের মানুষ কিনা একজন এম বি বি এস চিকিৎসকের তুলনায় এদের কথাই বিশ্বাস করে বেশী! আমার একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা বলি। এক রোগীকে দেশের প্রথম সারির একটি ফার্মাসিউটিক্যালস এর একটা মেডিসিন লিখে দিলাম, ৩ দিন পর রোগী এসে বলে ব্যথা কমছে না। ঔষধ দেখাতে বললে দেখালো, নাম না জানা এক কোম্পানীর একটা ব্যথার ঔষধ খাচ্ছে সে! ভালটা দিলাম এটা কেন খাচ্ছেন, এর জবাবে সে বলল, তাকে ফার্মাসীওয়ালা বলেছে ডাক্তাররা কমিশন খেয়ে দামি ঔষধ লিখে, তাই কম দামে ভাল ঔষধ দিয়েছে ফার্মাসীওয়ালা!!

এই রোগীগুলোই রোগ হলে দৌড়ে যায় ফার্মাসীতে। ফার্মাসীর লোকেরা না জেনে কিছু ঔষধ দেয়, যার ভেতর জনপ্রতি একটা না একটা এন্টিবায়োটিক থাকেই। এবং যেটা দেয়, সেটা হয় সেই রোগের এন্টিবায়োটিকই না অথবা ভুল ডোজে দিচ্ছে, তাও একদিন-দুইদিনের জন্য। রোগীরা যেহেতু সাময়িকভাবে ভাল বোধ করছেন, তারা সেই ফার্মাসীর লোকের ওপর আস্থা রাখছেন। কিন্তু কয়েকদিন পর রোগীর পুরোনো উপসর্গ আবার ফিরে আসে এবং এবার আরো বেশী হয়, কারন, উল্টোপাল্টা এন্টিবায়োটিক খাওয়ায় জীবানু শক্তিশালী হয়ে গেছে। তখন সেই ফার্মাসীওয়ালারা তাদেরকে নিজেরা নিজেরা কিছু ইনভেস্টিগেশন করায়, এবং স্থানীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকে ৩০% থেকে ৪৫% পর্যন্ত কমিশন খায়। পাব্লিক এতেও এদের সন্দেহ করে না!!

এরপর যখন রোগী ভাল হয় না, ফার্মাসী দোকানদারের এখানে আর কোন ব্যবসা থাকে না, সে তখন সরকারী হাসপাতালে পাঠায় এই রোগীদের, বলে দেয় “সরকারী ঔষধ খেলে ভাল হয়ে যাবেন।” এই রোগীরা কিন্তু ইতিমধ্যে রেজিস্ট্যান্ট জীবানু নিয়ে বসে আছে। তাই প্রয়োজন পড়ে কিছু ইনভেস্টিগেশনের, প্রয়োজন পড়ে কিছু ভাল ঔষধের। কিন্তু ততক্ষনে ফার্মাসীর দোকানদারের পাল্লায় পড়ে সে নি:স্ব। তাই ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে দিয়েও আমরা হয়ে যাই কশাই, সাধারন সরকারী সাপ্লাই ঔষধ না দিয়ে প্রয়োজনীয় ভাল ঔষধ প্রেসক্রাইব করেও হয়ে যাই কমিশন লোভী। আর মহামানব হয়ে বসে আছে আরেকজন!! এটাই বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য অন্যতম বড় হুমকি।

৭. ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানী : এই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের জন্য ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীগুলো অনেকাংশে দায়ী।

ক। তারা নতুন নতুন এন্টিবায়োটিক মার্কেটে নিয়ে আসছে খুব দ্রুত।
আর সেগুলোর পক্ষে এত এত প্রচারনা চালান যে, পুরাতনগুলো পেছনে পড়ে যায়। প্রতিটি এন্টিবায়োটিক মার্কেটে এভেইলেবল করার মধ্যে একটি প্রয়োজনীয় যৌক্তিক সময় পার্থক্য থাকা ভাল বলে আমি মনে করি। যেহেতু এদেশে কোয়াকরা এন্টিবায়োটিক এর অপব্যবহার করে, সেহেতু একসাথে কার্যকর সব এন্টিবায়োটিক বাজারে ছেড়ে দিলে সবগুলোই খুব দ্রুত অকার্যকর হয়ে যাবে।
আবার ভাল ব্যবসা করার জন্য অনেক পুরাতন কার্যকর এন্টিবায়োটিক তারা আর মার্কেটে আনেন না। এটাও একটা সমস্যা।

খ। এন্টিবায়োটিক সংক্রান্ত স্বচ্ছ, সঠিক তথ্য প্রচারনার অভাব। এন্টিবায়োটিক সম্পর্কে প্রফেশনালদের জানাতে কোম্পানীগুলো লিটারেচার তৈরী ও বিতরন করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দেয়া তথ্যগুলো গোলমেলে থাকে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র বেশ দুর্বল।

গ। ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীগুলো ফার্মাসী দোকানদারদের নিয়ে ঔষধের ওপর বিভিন্ন প্রোগ্রাম করেন। কিন্তু এটা হিতে বিপরীত হচ্ছে। ১০ মিনিটের একটা প্রেজেন্টেশন দেখে, (যার বেশিরভাগ অংশই এদের বোধগম্য না,) কি এন্টিবায়োটিক সাজেস্ট করা যায়? কিন্তু এই কাজটাই করে ফার্মাসীওয়ালারা দোকানে গিয়ে। “a little learning is a dangerous thing.” এই কথাটা ফলো করা উচিৎ ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীগুলোর। তারা একটা কথাই এই লোকগুলোর মাথায় ঢোকাবে যে, “রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোন ঔষধ বিক্রি করবে না। এবং এন্টিবায়োটিক কখনো পুরো কোর্স ছাড়া বিক্রি করবে না।”

ঘ। কমিশন দিয়ে ব্যবসা; এই কাজটা বড় কোম্পানীগুলো করেনা, করে ছোট কোম্পানীগুলো। তারা বড় কোম্পানীগুলোর চেয়ে বেশী প্রফিট মার্জিনে দোকানদারদের ঔষধ দেয়, বাকিতেও দেয়। আর নিজেদের নিম্নমানের ঔষধ বাজারে ভাল কোম্পানীর সমান খুচরা মূল্যে বিক্রি করে। স্বাভাবিকভাবেই এই টাইপ কোম্পানীর ঔষধ খুবই নিম্ন মানের হয়। কাজ করেনা। তাই সহজেই সঠিক এন্টিবায়োটিক খাবার পরও নিম্নমান ও কম পরিমানের কারনে রেজিস্ট্যান্স তৈরী হচ্ছে দিন দিন।

এবার কিছু ভয়ংকর তথ্য দেই। তথ্যগুলো সবই দেশে বিদেশের বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত এবং প্রকাশিত।

১. আমাদের দেশে ফার্মাসী থেকে এন্টিবায়োটিক কেন, কোন ঔষধ কিনতেই কোন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেশক্রিপশন প্রয়োজন হয় না! এটা গবেষণা করে বের করতে হয়!! বাস্তব জীবনে সবাই কম বেশী এভাবেই প্রেসক্রিপশন ছাড়া যে কোন ঔষধ কেনেন। এটা একমাত্র আমাদের দেশেই সম্ভব!! ভারতের ফার্মাসীতে পর্যন্ত এভাবে কিছু ওটিসি ড্রাগ ছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শপত্র না দেখাতে পারলে কোন ঔষধ বিক্রি করে না!

২. আমাদের দেশে দৈনিক শতকরা ৯২% ঔষধ বিক্রি হয় কোন প্রেসক্রিপশন ছাড়াই!!

৩. এভাবে সবচেয়ে বেশী ঔষধ বিক্রি হচ্ছে গ্রামের ও মফস্বল এলাকার ফার্মাসীগুলোতে।

৪. ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ঔষধের কাটতি বাড়াবার জন্য যেসব মোটিভেশনাল পেপার বিতরন করছে, সেগুলোতে অনেক অসমর্থিত ও বিশ্বাসযোগ্য রেফারেন্স ছাড়া তথ্য দিচ্ছে নিজেদের ঔষধ বিক্রির জন্য! এক মাস আগেও যে ঔষধের গুনগান করত, তার বদনাম শুরু করে তারা নতুন ঔষধ ব্র‍্যান্ড বের করলে। পুরাতনটা নতুন প্যাকে আনলে আবার সেগুলোর গুন গায়। অর্থাৎ তাদের এসব লিটারেচারের গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

৫. ঔষধের মান নিয়ন্ত্রনও একটা বড় ব্যাপার ভাল ও কার্যকরী ঔষধ পেতে হলে। কিন্তু হাতে গোনা ২/১ টি কোম্পানী ছাড়া বাকিদের অবস্থা আমাদের দেশে বড়ই করুন! যেমন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন এর ১৫টি ব্র‍্যান্ডের ঔষধ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, কোনটাতেই কার্যকর উপাদানের পরিমান উল্লিখিত পরিমানের শতকরা ৪৭ শতাংশের বেশী নেই!! অর্থাৎ, দাম দিয়ে ঔষধ কিনছেন, অর্ধেকেরও কম পাচ্ছেন পরিমানে!

৬. শূন্য থেকে চার বছর বয়েসী শিশুদের জন্য যে কোন রোগের চিকিৎসায় কেনা ঔষধের মধ্যে শতকরা ২৬ শতাংশ হল এন্টিবায়োটিক। এই রেজিস্ট্যান্সের জন্য সবচেয়ে বিপদজনক গ্রুপে আছে শিশুরা। শিশুদের নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার চিকিৎসায় যথাক্রমে শতকরা ৫৭.১% ও ৬৭.৮% ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক এর অপব্যবহার হয়!

৭. দেশে মোট বিক্রি হওয়া এন্টিবায়োটিক এর উপর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, শতকরা ৪৮% কেনা হচ্ছে সিংগেল ডোজ হিসেবে!! যেখানে মূল এন্টিবায়োটিক কোর্স হয়ত দিনে কয়েকবার করে, কয়েকদিন।

আমি যে কয়েকটি জার্নাল পড়েছি, তার মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তথ্য আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।

apuahmed_1439033096_02
আহমেদ মেজবাহ অপু

সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য!!

আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন, ঔষধের মেধাস্বত্ব বলে একটা জিনিস আছে। কিছু কিছু ঔষধের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ঔষধ শিল্প সংস্থা ও মূল মেধাস্বত্বধারী প্রতিষ্ঠানগুলো মানবিক দিক বিবেচনায় আমাদের জন্য এই মেধাস্বত্ব শিথিল করেছে। এজন্যে আমরা বিশ্ববাজারের তুলনায় অল্প দামে ঔষধ কিনতে পারছি।

এই মেধাস্বত্ব শিথিল চুক্তি গত বছর শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের কোম্পানীগুলোর অনুরোধে মানবিক দিক বিবেচনায় এই চুক্তি ২০৩৩ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর পর আর হয়ত বাড়ানো হবে না। আমাদের দেশের ঔষধ কোম্পানীগুলোর নিজস্ব কোন রিসার্চ নেই! তারা নিজেরা কোন ঔষধ আবিষ্কার করে না। তাই মেধাস্বত্ব চুক্তি শেষ হয়ে গেলে আর এভাবে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হতে থাকলে একদিন এদেশের মানুষ ব্যাকটেরিয়ার আক্রমনে নির্বংশ হবে! না কোন অপারেশন করা যাবে, না কোন সাধারন রোগের চিকিৎসা! কারন বাজারে যে অল্প কয়েকটা এন্টিবায়োটিক পাওয়া যাবে, তার মূল্য হবে আকাশছোঁয়া!

আইনস্টাইনকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি দিয়ে হবে সে সম্পর্কে তার কি মতামত?
তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, “তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা তো বলতে পারছি না, চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের কথা বলতে পারি! তখন মানুষ পাথর-কাঠের অস্ত্র দিয়ে লড়াই করবে, কারন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবে নিজেরা নিজেদের সভ্যতা ধ্বংশ করে ফেলবে!”

আর আমি বলব, যেভাবে আমরা এগুচ্ছি, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়ত আমাদের করতে হবে এন্টিবায়োটিক নিয়ে নিজেদের মধ্যে এবং এন্টিবায়োটিক দিয়ে সুপারবাগের বিরুদ্ধে! অস্ত্র এখানে কিছুই করতে পারবে না!!
সুপারবাগ হল এমন একটি জীবানু বা ব্যাকটেরিয়া, যার বিরুদ্ধে পৃথিবীতে আমাদের জানা প্রায় সব এন্টিবায়োটিকই অকার্যকর!!

কি করনীয় আমাদের?

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ করতে হলে একটাই কাজ আমাদের, যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হওয়া। একমাত্র এটাই আমাদের বাচাতে পারে।

কিন্তু সচেতন হবেন কিভাবে?
কে আপনাকে সচেতন করবে?

১. আপনি নিজেই হতে হবে: মনে রাখবেন, “self help is the best help.” যে কোন অসুখ হলে না জেনে, না বুঝে একটা ঔষধও খাবেন না। আশেপাশের লোক, এর ওর কথায় কোন ঔষধ খাবেন না। আর ভুলেও ফার্মাসীওয়ালার বুদ্ধিতে কোন ঔষধ খাবেন না। অসুস্থ হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। তার পরামর্শ নিন। অনেকেই খরচের কথা বলবেন। সাধারন কোন অসুখ দেখা দিলে শুরুতেই আপনার এলাকার কোন জেনারেল প্র‍্যাকটিশনার ন্যূনতম এম বি বি এস চিকিৎসকের কাছে যান। সম্ভব হলে আপনার বাসার কাছে একজন চিকিৎসককে প্রাইমারী ফ্যামিলি চিকিৎসক হিসেবে ফিক্স করুন। যে কোন ব্যাপারে তার পরামর্শ নিন। পরীক্ষা-নীরিক্ষার ভয় করবেন না। পরীক্ষা কোনটি কেন দিচ্ছেন জেনে নিতে পারেন, তবে জেনে নিয়ে আবার নিজে নিজে ডাক্তারী করবেন না। পরীক্ষা-নীরিক্ষাগুলো আই সি ডি ডি আর বি বা বি এস এম এম ইউ বা সি এম এইচ থেকে করানোর চেষ্টা করুন। খরচ কম পড়বে, রিপোর্ট বিশ্বাসযোগ্য।

২. সাধারন শিক্ষাব্যবস্থা : একটা কথা আছে, “বদ অভ্যাস ত্যাগ করার চেয়ে ভাল অভ্যাস তৈরী করা সহজ এবং উত্তম।” এজন্য, আমাদের সাধারন শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। যদিও স্কুল লেভেলে এগুলো চালু আছে, কিন্তু বইগুলোর মান যেমন ভাল নয়, তেমনি ভাল শিক্ষকও নেই। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠান ও শ্রেনী ভেদে মোট পাঠ্য বিষয়ের ১১% থেকে ৬৯% পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য আছে। এর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে আছে ৭% থেকে ৩৮%। কিন্তু এন্টিবায়োটিক ও তার ব্যবহার এবং রেজিস্ট্যান্সের ব্যাপারে কোন জ্ঞানই দেয়া হয় না। তাহলে কিভাবে ছোটবেলা থেকে আমরা শিশুদের সচেতন করব? প্রশ্ন রেখে গেলাম নীতি নির্ধারকদের কাছে।

৩. প্রিন্ট মিডিয়া বা সংবাদপত্র : এই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে এই সেক্টর অনেক শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য, এরা তা করছেন না!

বি এস এম এম ইউ এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, একটি সংবাদপত্রের মাত্র ০.৫% থেকে ২% পরিমান জায়গায় স্বাস্থ্য বিষয়ক সংবাদ বা তথ্য থাকে। আর এই অল্প খবরের মধ্যে ০% থেকে ০.৫% পরিমান খবর থাকে ঔষধ বিষয়ক সচেতনতা নিয়ে। আর এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে তো কোন নিউজই থাকে না। অতএব, সংবাদপত্রগুলোর উচিৎ নিজেরা নিজেরা ফার্মাসীর কোয়াকদের মত না জেনে ভুল চিকিৎসা নিরুপন করার চেষ্টা না করে, যথার্থ জনস্বাস্থ্য বিষয়ক যাচাইকৃত সঠিক তথ্য প্রচার করা।

৪. ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া : এই সেক্টর তো বর্তমানে প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়েও শক্তিশালী। বিটিভির যুগে শুধুমাত্র স্বাস্থ্য বিষয়ক কিছু শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে খুব অল্প সময়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব ঘটে গেছে। কিন্তু এখন আকাশ সংস্কৃতির যুগে বিটিভির কদর কমে গেছে। মানুষ ঝুকে পড়েছে অন্য চ্যানেলগুলোর দিকে। কিন্তু তারা কিভাবে স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা দেখছেন?
বি এস এম এম ইউ এর এক সমীক্ষায় এসেছে, একটি চ্যানেলে দৈনিক গড়ে মোট অনুষ্ঠান প্রচারনার সময়ের মাত্র ০.৪% সময় দিচ্ছে স্বাস্থ্য বিষয়ক যে কোন তথ্য প্রচারে। আর এই সময়ের ০.০২% সময় ব্যয় করে ঔষধ বিষয়ক তথ্য প্রচারনায় আর এই সময়ের ০.০১% সময় ব্যয় করে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে তথ্য প্রচারে!

এভাবে এই হারে তথ্য প্রচার করলে কিভাবে জনগন সচেতন হবে বলুন! তাই যথাযথ স্বাস্থ্য বিষয়ক, বিশেষ করে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের মত জরুরী বিষয়ে সচেতনতামূলক তথ্য প্রচারে সজাগ হওয়া উচিৎ সকল দেশীয় বেতার ও টিভি চ্যানেলের।

৫. স্বাস্থ্য বিভাগ : রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে নাগরিকদের এই আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচাতে। একমাত্র রাষ্ট্রই পারে বড় স্কেলে এটা করতে। এই বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরীতে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য বিভাগ ও ঔষধ প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। আইন প্রয়োগ করে ভুয়া ফার্মাসী ও ভুয়া ফার্মাসিউটিক্যাল বন্ধ করতে হবে। ড্রাগ পলিসি রিভাইস করতে হবে বর্তমান প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে। একই সাথে দেশের সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের বর্তমান অবস্থা নিরূপন করে একটি প্রপার ন্যাশনাল প্রেশক্রাইবিং গাইডলাইন তৈরী করতে হবে এবিং মেনে চলা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সরকারীভাবে অজ্ঞ লোকেদের এন্টিবায়োটিক বিতরনের কাজ থেকে সরিয়ে আনতে হবে এবং যোগ্যদের কাজে লাগাতে হবে।

৬. চিকিৎসক : রোগীদের সচেতন করার আগে, নিজে সচেতন হতে হবে। কেন আপনি ৩/৫ দিনের সাধারন জ্বরে এন্টিবায়োটিক দিচ্ছেন না, সেটা খুলে বলুন। এন্টিবায়োটিক দিলে অবশ্যই সেটা সঠিকভাবে সেবনের নিয়ম বার বার বলে মাথায় গেথে দিন। ডোজ মিস করলে বা ইচ্ছে করে কয়েকটা খেয়ে পুরো কোর্স শেষ না করলে কি সমস্যা হবে, সেটা বুঝিয়ে বলে দেবেন। কোন ডোজ ভুলে বাদ পড়ে গেলে কি করনীয়, সেটাও বলে দেবেন। না জেনে, না বুঝে যাতে এন্টিবায়োটিক না খায়, সেজন্য কাউন্সিলিং করতে হবে। মোটকথা, আপনাকে রোগীর বন্ধু হতে হবে।

৭. চিকিৎসক ব্যতীত স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বাকিরা : নার্স, স্যাকমো ও অন্যান্য যারা এই খাতের সাথে যুক্ত, আপনাদের কাছে আকুল আবেদন, দয়া করে না জেনে না বুঝে রোগীদের কোন ধরনের ঔষধ দিবেন না। রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছাড়া কেউ রোগীদের এন্টিবায়োটিক দেবার এখতিয়ার রাখেন না। অতএব, দেশের মানুষের, নিজের কাছের মানুষের এতটা ক্ষতি করবেন না প্লিজ।

৮. ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান : আপনারা দয়া করে কয়টা টাকা লাভের জন্য দেশের মানুষের এতবড় ক্ষতি করবেন না। ঔষধ সম্পর্কে জনগন ও চিকিৎসকদের সঠিক-নির্ভরযোগ্য তথ্য দিন। ঔষধের সঠিক পরিমান ও মান নিয়ন্ত্রন করুন। জনগনকে ও ফার্মাসীর দোকানদারদের এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের বিষয়ে সচেতন করুন। নিজেরা রিসার্চে বিনিয়োগ করুন ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে।

৯. মৎস্য ও পশু সম্পদ বিভাগ : গবাদি পশু ও মাছ চাষ বা ফসলী জমিতে কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের আগে অবশ্যই যথাযথ মনিটরিং নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। এর দায়িত্ব অবশ্যই মৎস্য ও পশু সম্পদ বিভাগের। মাঠপর্যায়ের কৃষকদের সচেতন করতে হবে, ভেটেরিনারি চিকিৎসকদের ও সচেতন হতে হবে।

সব শেষে একটা কথাই বলব, প্লিজ সচেতন হোন। নিজেরা নিজেদের নির্বংশ করবেন না।
না হলে এই দেশ একদিন মহাশ্মশানে পরিনত হতে বাধ্য!

আর এই পরিনতির জন্য আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আজীবন ধিকৃতই থেকে যাব! (যদি ততদিনে আমরা পুরোপুরি নির্বংশ না হয়ে যাই!!)



মন্তব্য চালু নেই