বৌদিই দিদির সামনে

বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা নাগাদ রায়গঞ্জের প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদকে ১০, জনপথে ডেকে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী জানিয়ে দিয়েছেন, ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁকেই প্রার্থী করছে দল। দীপা যেন সেই ‘চ্যালেঞ্জ’ গ্রহণ করেন।

ইমেলে জবাবের আশায় বসেছিলেন দীপা দাশমুন্সি।
মেল আসেনি। সরাসরি ডাকই এসেছে!

বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা নাগাদ রায়গঞ্জের প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদকে ১০, জনপথে ডেকে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী জানিয়ে দিয়েছেন, ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁকেই প্রার্থী করছে দল। দীপা যেন সেই ‘চ্যালেঞ্জ’ গ্রহণ করেন। কারণ, কংগ্রেস চাইছে, ভবানীপুরে মমতার বিরুদ্ধে ‘পোক্ত’ প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তৃণমূলকে সামগ্রিকভাবে একটা ‘বার্তা’ দিতে। দীপা প্রাথমিকভাবে বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, ভবানীপুরে কংগ্রেসের সংগঠন দুর্বল। ওই আসনে হার নিশ্চিত। বরং তিনি উত্তরবঙ্গ-সহ গোটা রাজ্য জুড়ে প্রচার করতে আগ্রহী। কিন্তু সনিয়া সেই আর্জি মানতে চাননি। ফলে দীপাকে রাজি হতেই হয়েছে।
আজ, শুক্রবার সকালে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটি বৈঠকে বসে চূড়ান্ত প্রার্থীতালিকা ঘোষণা করবে। সেখানেই ১৫৯ নম্বর ভবানীপুর কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে দীপার নাম ঘোষিত হওয়ার কথা।
তিনি কি ভবানীপুরে কংগ্রেসের প্রার্থী হচ্ছেন?

সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি দীপা। ফোন ধরেননি। টেক্সট মেসেজেরও জবাব দেননি। কিন্তু শীর্ষ কংগ্রেস সূত্র বলছে, ভবানীপুর দিদি বনাম বৌদি লড়াই-ই দেখবে।

গত কয়েকদিন ধরেই ভবানীপুরে দীপার প্রার্থিপদ নিয়ে জল্পনা চলছিল। বুধবার প্রদেশ নির্বাচনী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি আলোচিত হয়। কিন্তু দীপা তখনও ভবানীপুরে লড়তে রাজি ছিলেন না। বস্তুত, প্রথমে ওই আসনে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ওমপ্রকাশ মিশ্রের নাম ঘোষণা করেই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা ওমপ্রকাশবাবুর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে এআইসিসি’র কাছে পাঠাব। বলব, আগে এই নামটা অনুমোদন করে দিন। তার পরে বাকি।’’

প্রদেশ কংগ্রেস সূত্রের খবর, তার পর থেকেই রাজ্য কংগ্রেসের মধ্যে এই মর্মে জল্পনা শুরু হয় যে, ওমপ্রকাশ প্রার্থী হিসেবে ‘দুর্বল’। মমতার বিরুদ্ধে ‘জোরাল’ প্রার্থী না-দাঁড় করালে এই বার্তা দেওয়া যাবে না যে, কংগ্রেস বিধানসভা ভোটের লড়াই নিয়ে ‘আন্তরিক’। তখন থেকেই দীপার নাম নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু। তখন থেকেই বিভিন্ন সূত্রে দীপাকে ‘বাজিয়ে’ দেখা হচ্ছিল। কিন্তু তিনি সকলকেই বলছিলেন, ভবানীপুরে তিনি লড়তে চান না। সেটা অস্বাভাবিকও নয়। মমতা-দীপা যা সম্পর্ক, তাতে নিশ্চিত হারের একটি আসনে কে-ই বা জেনেশুনে যেতে চায়! তাছাড়া, ভবানীপুরে কংগ্রেসের সংগঠনও অত্যন্ত পলকা। দীপা ওই প্রস্তাবকদের এমনও জানিয়েছিলেন যে, তিনি আদৌ বিধানসভা ভোটে লড়তে আগ্রহী নন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর নাম নিয়ে জল্পনা থামেনি।

দিনতিনেক আগে দীপাকে একটি টেক্সট মেসেজে অধীর বলেন, দীপা কি ভবানীপুরে লড়তে রাজি আছেন? তাঁকে অত্যন্ত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ (ভিআইপি) কয়েকজন ওই আসনের জন্য দীপার নাম বলেছেন। পাল্টা মেসেজে দীপা জানান, তাঁর তেমন কোনও ইচ্ছা নেই। তবে হাইকম্যান্ড বললে তিনি তা মানতে বাধ্য। অধীর আবার মেসেজ পাঠান, ‘দারুণ হবে। রাজি হয়ে যান বৌদি’। দীপা তার কোনও জবাব দেননি।

ঘটনাচক্রে, সেদিনই দীপা রাতে দিল্লি থেকে কলকাতায় আসেন। বিমানে ওঠার আগে তিনি সনিয়াকে একটি ইমেল পাঠিয়ে জানান, ভবানীপুরে তাঁর নাম নিয়ে জল্পনা চলছে। তিনি ওই বিষয়ে কংগ্রেস সভানেত্রীর পরামর্শ চান। কলকাতায় নেমে দীপা সনিয়ার দফতরে ফোন করে জানতে পারেন, তাঁর ইমেল পৌঁছেছে। সেটির ‘প্রিন্ট-আউট’ সনিয়ার টেবিলে পৌঁছেও দেওয়া হয়েছে। তখন থেকেই সনিয়ার জবাবের আশায় ছিলেন দীপা। কিন্তু জবাব আসেনি।

এর মধ্যেই বুধবার প্রদেশ নির্বাচনী কমিটির বৈঠকে ভবানীপুর নিয়ে একপ্রস্ত নাটক হয়।
আসন ধরে ধরে প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করার সময়ে ভবানীপুরের নাম আসা মাত্রই দীপা বলে ওঠেন, ওমপ্রকাশ মিশ্র। একই নাম বলেন বৈঠকে উপস্থিত মানস ভুঁইয়াও। সেইমতোই তালিকায় ওমপ্রকাশের নাম লিখতে শুরু করেন এআইসিসি’র স্ক্রিনিং কমিটির সদস্য বি কে হরিপ্রসাদ। তখনই আমতা-আমতা করে কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা মহম্মদ সোহরাব বলেন, ‘‘আমি কি ওটা বলব?’’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, সোহরাবের প্রশ্ন বৈঠকে পড়তে না-পড়তেই অধীর তাঁকে ‘ইতিবাচক’ ইশারা করেন। সোহরাব তখন বলেন, কালকের (মঙ্গলবার, দিল্লিতে) বৈঠকে ‘ম্যাডাম’ দীপার নাম বলেছেন ভবানীপুরের জন্য। দীপা পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘‘কে বলেছেন? ম্যাডাম?!’’ সোহরাব আবার আমতা-আমতা করে জানান, ‘ম্যাডাম’ সরাসরি দীপার নাম বলেননি। দীপার নাম আসলে বলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি (অধীর)। ‘ম্যাডাম’ বলেছেন, দীপার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। দীপা তখন বলেন, তাঁর কাছে সনিয়া বা হাইকম্যান্ডের তরফে কোনও বার্তা আসেনি। তবে ভবানীপুরে লড়তে বলে অধীর তাঁকে একটি মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, ভবানীপুরে লড়তে তাঁর ইচ্ছা নেই। তবে তিনি দলের অনুগত সৈনিক। ফলে সনিয়া বললে সেই নির্দেশ তিনি ফেলতে পারবেন না।

তখন হরিপ্রসাদ জানান, সনিয়া বলেছেন, ভবানীপুরের জন্য তিনি যা ভাল বুঝবেন, সেটাই করবেন। ফলে গোটা বিষয়টি কংগ্রেস সভানেত্রীর উপরেই ছেড়ে দেওয়া হোক। সেইমতোই বিষয়টি সনিয়ার উপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে ভবানীপুর নিয়ে আর কোনও আলোচনাই হয়নি। যা বৃহস্পতিবার ‘এবেলা’য় প্রকাশিত হয়েছিল।

এদিনই সকালে দীপা দিল্লি যান। তখনও তাঁর কাছে সনিয়ার তরফে কোনও জবাব আসেনি। শেষপর্যন্ত বেলা ১২টার কিছু আগে দীপার ডাক আসে জনপথ থেকে। ১২টা নাগাদ তিনি গিয়ে কংগ্রেস সভানেত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। সনিয়া সরাসরিই দীপাকে জানান, তাঁকেই মমতার বিরুদ্ধে ভবানীপুরে লড়তে হবে। প্রাথমিকভাবে খানিকটা অনীহা প্রকাশ করলেও শেষপর্যন্ত দীপা আর ‘না’ বলতে পারেননি। কংগ্রেস সূত্রের খবর, এআইসিসি’র বেশিরভাগ সদস্য মমতার বিরুদ্ধে দীপাকে প্রার্থী করার পক্ষেই রায় দিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষেই ওই সিদ্ধান্ত নেন সনিয়া।

তবে কংগ্রেস মনে করছে, মমতার বিরুদ্ধে দীপা ‘লড়াই’ দিতে পারবেন। দলের এক শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘আমরা যে ভবানীপুরে মমতাকে ওয়াক-ওভার দিচ্ছি না, সেটা বোঝাতে ওখানে একজন হেভিওয়েটকে দরকার ছিল। যেমন একটা সময়ে কর্নাটকের বল্লারীতে সনিয়া’জির বিরুদ্ধে সুষমা স্বরাজ প্রার্থী হয়েছিলেন। সুষমা জানতেন, তিনি হারবেন। তা সত্ত্বেও দলের নির্দেশে তাঁকে ওখানে লড়তে হয়েছিল। ফলে একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল। বিনা যুদ্ধে ময়দান ছেড়ে দেয়নি বিজেপি। এখানেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে হাওয়া উঠেছে, তাতে সওয়ার হতে গেলে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে জোরাল প্রার্থী দেওয়া দরকার। সেইজন্যই দীপা দাশমুন্সির নাম প্রস্তাব করা হয়। ম্যাডামও রাজি হন।’’

পুনশ্চ: প্রায় কান্নাকাটির অবস্থা হয়েছিল ‘স্বর্ণাক্ষর’ ওমপ্রকাশের। তবে শোনা যাচ্ছে, তিনি বালিগঞ্জ পেতে পারেন।

সূত্র: এবেলা



মন্তব্য চালু নেই