বুয়াজিজির আগুন ছড়িয়ে পড়ল আরবজুড়ে

কথিত আরব বসন্তের সূচনার সূচনা দিন বলা হয় আজ ১৭ ডিসেম্বরকে। পাঁচ বছর আগের এই দিনে তিউনিশিয়ার ২৬ বছর বয়সী মোহাম্মদ বুয়াজিজি নামে এক হকার পুলিশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নিজ শহর সিদি বুজিদের মিউনিসিপাল অফিসের বাইরে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন।

তার ওই আগুন পরবর্তী সময়ে তিউনিশিয়া ছাড়িয়ে ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত পুরো আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বুয়াজিজি মারা গেলে তিউনিশিয়াজুড়ে ব্যাপক গণবিক্ষোভ শুরু হয়। দেশটির রাজনীতিতে একের পর এক পরিবর্তন ঘট থাকে। সর্বশেষ ওই বছর বিক্ষোভের মুখে দুই দশক ধরে শাসন করে দেশটির প্রেসিডেন্ট জিনে এল আবেদিন বেন আলি অন্য ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় বসলেও দেশটিতে নানা জাতিগত ও ধর্মভিত্তিক ও উদার রাজনৈতিক দলের মধ্যে সহিংসতা লেগেই ছিল। সুশীল সমাজের মধ্যস্থতায় দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১৪ সালে তিউনিশিয়ায় একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটি মোটামুটি স্থিতিশীলতার পথে থাকলেও ভয়াবহ বেকারত্ম দেশটিতে ঝেঁকে বসেছে। জাতীয় সংলাপে মধ্যস্থতাকারী চারটি সংগঠন শান্তি আলোচনায় বিশেষ অবদানের জন্য এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়। তবে তিউনিশিয়ায় পুরোপুরি শান্তি প্রতিষ্ঠা এখনো অধরা থেকে গেছে। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার তরুণরা হতাশ হয়ে সন্ত্রাসের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক তরুণ ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে।

এদিকে তিউনিশিয়া থেকে সূত্রপাত হওয়া আগুন লিবিয়া, মিশর হয়ে বর্তমানে সিরিয়া পর্যন্ত জ্বলছে। এসব রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আসার পরিবর্তে সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। এ কয়েক বছরে কয়েক লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়েছে আরো বেশ কয়েক লাখ।

যেই স্বপ্ন নিয়ে যুবক বুয়াজিজি আত্মহুতি দিয়েছেন, তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে কি? নানা ঘটনা ও বর্তমান বাস্তবতায় এ প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। বুয়াজিজির নিজ শহর সিদি বুজিদের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, বর্তমান অবস্থার চেয়ে বরং ওই ঘটনার আগের অবস্থা ভালো ছিল।

সিদি বুয়াদি থেকে স্নাতক করা রামজি আবদুলি নামে এক তরুণ আল জাজিরাকে একরাশ হাতাশা নিয়েই বলেন, ‘এখন আমরা প্রত্যাশা করি বেন আলির শাসন যেন আবার ফিরে আসে।। ভেবেছিলাম, বেন আলি ক্ষমতা থেকে সরে গেলে প্রকৃত অর্থেই অবস্থার উন্নতি হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা হয়নি।’

অনেক তরুণের মতো ২০১০-২০১১ সালের গণবিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন আবদুলি। বেন আলির পতনের পর নিজ শহর সিদি বুজিদ থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে রাজধানী তিউনিসে এসে ২০১২ সালে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন’ এর নতুন আন্দোলনে সরিক হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তিনি বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনা করে যাচ্ছেন। সামনে যে অবস্থার পরিবর্তন হবে সে বিষয়েও তিনি অনেকটা হতাশ।

‘সিদি বুজিদের প্রত্যেকটি তরুণের এই মনোভাব জাগ্রত রয়েছে, তাদেরকে উপেক্ষিত করা হচ্ছে। ছুড়ে ফেলা দেওয়া হচ্ছে প্রান্তিক অবস্থানের দিকে। সামাজিক ন্যায়বিচার ও উন্নয়নের যে দাবি ছিল তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এসব তরুণকে।’

আবদুলি বলেন, ‘তিউনিশিয়ান তরুণদের কী পরিমাণ হতাশায় রয়েছে, তার প্রমাণ দেশটির অনেক তরুণ এখন সিরিয়া ও ইরাকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসে গিয়ে যোগ দিচ্ছে। আইএসে যোগ দেওয়া অনেক তরুণ আমার সহকর্মী ছিল। আমি শুনেছি সেখানে যুদ্ধে অনেকে নিহত হয়েছে, কেউ কেউ সিরিয়াতে জেল খাটছে।’

তিনি বলেন, ‘তারা ছিল খুবই তারুণ্যদ্বীপ্ত, পরিশ্রমী ও শিক্ষিত। তারা যখন দেখল বেকারত্ম অবসানের কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন হতাশা থেকেই তারা আইএসে যোগ দিতে গেছে।’
‘দিন দিন আমাদের স্বপ্ন ভেঙে চুড়মাড় হয়ে যাচ্ছে। এক কোটি ২০ লাখ বেবার যুবককে দেশটির সন্ত্রাসী, দারিদ্র্য ও দুর্নীতির উর্বর ভূমিতে পরিণত করছে। তরুণরা আরো ভয়ঙ্কর কিছু সিদ্ধান্ত নিলে এর দায়-দায়িত্ব এই রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে।’

তথ্যসূত্র : আল জাজিরা অনলাইন।



মন্তব্য চালু নেই