বিয়ে নিয়ে বাবাকে যা বলেছিলেন তনু

তনুর বাবা ইয়ার হোসেন। বাবার আদরের কন্যা ছিলেন তনু। তিনি বলেন, তনু দুটি টিউশনি করতো। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বাসা থেকে বের হতো। ওর মা আনোয়ারা বেগম এগিয়ে দিত। রাতে ফেরার পথেও ওর মা এগিয়ে নিয়ে আসতো। যেখানে টিউশনি করতো তার দূরত্ব বাসা থেকে ২০০ গজ হবে।

হত্যাকাণ্ডের স্থল বাসা থেকে ১০০ গজ দূরে। আমি এখানে ৩১ বছর ধরে চাকরি করি। আট বছর ধরে কোয়ার্টারে থাকি। সেনানিবাসের সুরক্ষিত এলাকায় কারা ওকে মেরেছে জানি না। আল্লাহ দেখেছেন। আমি তনুর হত্যাকারীদের কঠিন বিচার চাই।

তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারীর চাকরি করেন। ঘটনার দিন তিনি রাত সোয়া ১০টার দিকে বাসায় ফিরে শোনেন মেয়ে তখনও ফিরেনি। টর্চলাইট নিয়ে মেয়ের খোঁজে বের হন তিনি। তখন রাত সোয়া ১০টার বেশি।

বাসার কাছেই একটি কালভার্ট আছে। কালভার্টের পাশেই দেখেন তনুর একটি জুতা পড়ে আছে। দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠেন তিনি। এরপর তার ছোট ছেলে আনোয়ার হোসেন রুবেলও বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। কিছু দূরে ওর মোবাইল ফোনটা পড়েছিল।

একটু উঁচু জায়গায় জঙ্গলের মধ্যে খুঁজতে গিয়ে শুধু সন্তানের লাশটাই পেলেন তার বাবা। মাথার নিচটা থেঁতলে আছে। ওর মুখে রক্ত আর আঁচড়ের দাগ।

রক্তাক্ত মেয়ের লাশ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তনুর বাবা।

গত ২০ মার্চ সন্ধ্যায় টিউশনি করে বাসায় ফেরার পথে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ময়নামতি সেনানিবাস এলাকার পাওয়ার হাউসের পানির ট্যাংকের পাশে তনুর মাথা থেঁতলানো মৃতদেহ খুঁজে পান তার বাবা। পরে লাশ কুমিল্লা সিএমএইচে নিয়ে যান তারা।

তনুর বড় ভাই নাজমুল হোসেন বলেন, আমরা ভাই-বোনেরা বন্ধুর মতো ছিলাম। তার নেতৃত্ব দেয়ার একটা হবি ছিল। স্কুল-কলেজে সে ক্লাসে ক্যাপ্টেন হতো। তার ইচ্ছে ছিল শিক্ষক হওয়ার। বাবা একদিন তাকে বলেছিলেন, মা তোমাকে বিয়ে দিতে চাই। তোমার কোনো পছন্দের ছেলে আছে কিনা। সে বলেছিল তার পছন্দ নেই। তবে অনার্স শেষ করার পর বিয়ে করবে বলে জানিয়েছিল।

তনুদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে। এখন পুরো পরিবার সেখানে অবস্থান করছে।

কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আবদুর রব গণমাধ্যমকে বলেন, ২১ মার্চ তনুর বাবা কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ২১ মার্চ সিএমএইচ থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। তনুর লাশে কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন ছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তাকে পাশবিক নির্যাতনের চেষ্টা করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে জানা যাবে।

তনুর লাশ উদ্ধারের স্থান পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল। তিনি বলেন, আমরা সেনানিবাসের ভেতরে হত্যাকাণ্ডের স্থান পরিদর্শন করেছি। আশা করছি, খুব শিগগিরই খুনিরা শনাক্ত হবে। তনুর পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। তনুর পরিবারকে জমিসহ একটি ঘর করে দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে তনু হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে উত্তাল কুমিল্লা। মাঠে নেমেছিল তার ৩০ হাজার সহপাঠী। বসে থাকতে পারেননি রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও। তনুর বন্ধুদের সঙ্গে হাতে হাত ধরে মাঠে নেমে আসেন তারা। সব ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারেই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাকর্মীরা।

এমন দৃশ্য দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে আন্দোলনের শক্তি বেড়ে গেছে।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদেরও বারবার চোখ মুছতে দেখা গেছে।
তনু হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে কুমিল্লার কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে নেমে এসেছেন সর্বস্তরের জনতা।

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার তনু হত্যায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ২৭ মার্চ কুমিল্লা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণা দিয়েছেন।

শুক্রবার বিকেলে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে তনু হত্যার বিচারের দাবিতে গণসমাবেশে লংমার্চের ঘোষণা দেন তিনি। আগামী রোববার সকাল ৮টায় রাজধানীর শাহবাগ থেকে এ লংমার্চের যাত্রা শুরু হবে।

এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কুমিল্লাবাসী জেগে উঠেছে, পুরো বাংলাদেশ জেগে উঠবে। আমাদের নারীনেত্রী যারা আছেন তাদের এ বিষয়ে স্বেচ্ছায় জেগে উঠতে হবে।

তিনি বলেন, তনু আমাদের মেয়ে। তাকে নিরাপদ স্থানে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। সোহাগী জাহান তনুকে হত্যা ও পাশবিক নির্যাতনের প্রতিবাদে গোটা দেশকে জেগে উঠতে হবে। কুমিল্লাবাসী জেগে উঠেছে। পুরো বাংলাদেশ জেগে উঠবে।

শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে স্বাধীনতা দিবসের এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।



মন্তব্য চালু নেই