বিশ্বজিৎ হত্যা : আসামিরা কে কোথায়

চাঞ্চল্যকর বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি আগামীকাল মঙ্গলবার। এ আলোচিত মামলার রায়ের পর কেটে গেছে প্রায় এক বছর। অথচ সাজাপ্রাপ্ত বেশিরভাগ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। গুরুত্বপূর্ণ এই মামলার ২১ আসামির মধ্যে আটজন গ্রেফতার হলেও বাকি ১৩ আসামি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পলাতক ১৩ আসামির মধ্যে দুজনের মৃত্যুদণ্ড ও বাকি ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। পুলিশ বলছে, আসামিদের ধরতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়েছে। তবে অধিকাংশ আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় চরম শঙ্কায় রয়েছেন বিশ্বজিৎ দাসের পরিবারসহ মামলার সাক্ষীরা।

ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা ফাঁসির দুই আসামি হলেন রাজন তালুকদার ও নুরে আলম লিমন। আর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১১ আসামি হলেন : খন্দকার ইউনুস আলী, তারেক বিন জোহর তমাল, আলাউদ্দিন, ওবায়দুল কাদের, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল-আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, কামরুল হাসান ও মোশারফ হোসেন।

গ্রেফতারকৃত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন : রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, কাইয়ুম মিয়া টিপু ও সাইফুল ইসলাম। আর যাবজ্জীবনপ্রাপ্তরা হলেন গোলাম মোস্তফা ও কিবরিয়া।

গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক এ বি এম নিজামুল হক চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় দেন। এর আগে ওই বছরের ৪ ডিসেম্বর আসামিপক্ষের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষে বিচারক রায়ের দিন ধার্য করেন।

রায় কার্যকর নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বিশ্বজিতের বড় ভাই উত্তম কুমার বলেন, ‘এক বছর আগে রায় হয়েছে। উচ্চ আদালতে খালাস চেয়ে আসামিরা আবেদন করেছেন। শুনেছি, তারা নাকি খালাস পেয়ে যাবেন। রায়ের দিন পরিবার খুব খুশি হলেও ধীরে ধীরে তা ম্লান হয়ে গেছে। দুনিয়াতে তাদের বিচার না হলেও সৃষ্টিকর্তা তাদের তো ছাড়বেন না। কোথাও না কোথাও তারা এমনিভাবে মানুষের হাতে মরবে।’

অভিযোগ ওঠে, চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার রায়ের পর আসামিপক্ষ নির্ধারিত সময় ৬০ দিন পার করে উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন। আপিলের পর মামলাটি শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। তবে কবে নাগাদ শুনানি হবে তা জানা যায়নি।

আসামিদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান জানান, যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিলের আবেদন করা হয়েছে। আপিল নিষ্পত্তির আগে মামলার ব্যাপারে কিছুই বলা যাচ্ছে না।

এদিকে পলাতক আসামিদের অনেকেই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমন অভিযোগ করেছেন বিশ্বজিতের পরিবারের লোকজন ও আইনজীবীরা। তারা জানান, মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত ১৩ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের অনেকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে তাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশপাশেও দেখা যায়।

বাদীপক্ষের আইনজীবীরা আরো জানান, হত্যার রায় ঘোষণার প্রায় এক বছর পার হতে চললেও সাজাপ্রাপ্ত পলাতক ১৩ আসামিকে পুলিশ ইচ্ছা করেই গ্রেফতার করছে না। আসামিরা সরকারি দলের হওয়ায় তাদের অনেকটা এড়িয়ে চলা হচ্ছে। আদালত তাদের বিরুদ্ধে একাধিকবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও তাদের গ্রেফতারে পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কোনো উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, ১৩ আসামির মধ্যে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন খন্দকার ইউনুস আলী, তারেক বিন জোহর তমাল, ওবায়দুল কাদের, আজিজুর রহমান, মীর নূরে আলম লিমন, আল-আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, কামরুল হাসান ও মোশারফ হোসেন।

ওই সূত্রটি আরো জানায়, তাদের মধ্যে রাজন তালুকদার এখন কলকাতায় অবস্থান করছেন। ইমরান, পাভেল ও আলাউদ্দিনসহ কয়েকজন দয়াগঞ্জ এলাকায় বসবাস করছেন।

এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি এফ এম শরিফুর ইসলাম বলেন, ‘আমার ছত্রচ্ছায়ায় আসামিরা ঘুরে বেড়ান, এ কথা যারা বলেছেন, তারা হয়তো আমাকেই চেনেন না। ঘটনার পর আসামিদের সঙ্গে আমার কোনো প্রকার যোগাযোগ হয়নি। বর্তমানে তারা কে কোথায় আছেন, তাও জানি না আমি।’

এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ওয়াহেদ জানান, বিশ্বজিৎ হত্যার কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্তের মাধ্যমে ১০ জনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার ও তিনজনের সনদ বাতিল করে। বহিষ্কৃতরা হলেন : কাইয়ুম, রাজন, সাইফুল, শাওন, শাকিল, নুর আলম, ওবায়দুল, মশিউর রহমান, মামুন ও তাহসিন। আর সনদ বাতিল হয়েছে মাহফুজুর রহমান, ইমদাদুল ও কিবরিয়ার। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কিছু করার নেই বলে জানান তিনি।

কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না আসামিদের- জানতে চাইলে সূত্রাপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খলিলুর রহমান বলেন, মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে স্থানান্তর করা হয়েছে। সুতরাং আসামি গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি গোয়েন্দা বিভাগই ভালো বলতে পারবে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে গোয়েন্দা কার্যালয়ের পরিদর্শক তাজুল ইসলামের কাছে গেলে তিনি বলেন, রায়ের পর আর কোনো আসামিকে গ্রেফতার করা যায়নি। তারা দেশের বাইরে আছেন, এমনটা শোনা গেছে। তবে আসামিদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হয়। কেউ সংবাদ দিলেও সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এভাবে গ্রেফতার-প্রক্রিয়া ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধের মধ্যে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে জামায়াত-শিবির সন্দেহে বিশ্বজিৎকে ধাওয়া করা হয়। প্রাণ বাঁচাতে বিশ্বজিৎ একটি মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নিলেও সেখানে তাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মারাত্মক জখম অবস্থায় বিশ্বজিৎ রাস্তায় পড়ে থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেননি। পরে এক রিকশাচালক স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। জেগে ওঠে বিশ্ববিবেক। নাড়া দিয়ে ওঠে মানুষের জাগ্রত হৃদয়। বিশ্বজিতের খুনিদের গ্রেফতার করে অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনার দাবি ওঠে সব মহলে।

ঘটনার দিন অজ্ঞাতনামা ২৫ জনকে আসামি করে সূত্রাপুর থানায় মামলা দায়ের করেন এসআই জালাল আহমেদ। এরপর মামলাটি থানা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা অফিসে হস্তান্তর করা হয়। মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ২০১৩ সালের ৫ মার্চ ২১ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক তাজুল ইসলাম।



মন্তব্য চালু নেই