বিপুল প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান ভোলায়

দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ জেলা ভোলায় বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের অবস্থান চিহ্নিত হয়েছে। সেখানে বিদ্যমান শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে প্রায় ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ভূগর্ভে এই গ্যাস রয়েছে। রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কোম্পানি (বাপেক্স) ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করে গ্যাসের এই অবস্থান চিহ্নিত করেছে।

এই জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে এখন সেখানে বিদ্যমান চারটি কূপের পাশাপাশি আরও দুটি অনুসন্ধান কূপ খননের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ভোলায় বাপেক্সের খননযন্ত্রও (রিগ) নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, ভোলার শাহবাজপুর ক্ষেত্রে যে গ্যাসের একটি সমৃদ্ধ মজুত রয়েছে, তা আগেই অনেকের জানা। ক্ষেত্রটিতে যে মজুতের কথা সবাই জানে (৬৬৫ বিলিয়ন ঘনফুট বা বিসিএফ), সেখানে তার চেয়ে বেশি মজুত রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে সেটিকে একটি বড় ক্ষেত্র বলা যাবে। কোনো ক্ষেত্রে এক টিসিএফ গ্যাস থাকলেই তাকে বড় ক্ষেত্র বলা হয়ে থাকে। এখন ত্রিমাত্রিক জরিপের ভিত্তিতে নতুন অনুসন্ধান কূপ করলেই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।

বদরূল ইমাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ইউনোকল একটি জরিপের ভিত্তিতে শাহবাজপুরে দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস মজুতের সম্ভাবনার কথা বলেছিল। তখন তারা ওই গ্যাস তুলে তা দিয়ে বরিশাল, খুলনা ও যশোর অঞ্চলে সরবরাহের একটি কর্মপরিকল্পনাও সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছিল। কিন্তু পরে ইউনোকলের সঙ্গে সরকারের চুক্তি না হওয়ায় পরিকল্পনাটি আর এগোয়নি। এখন বাপেক্স যদি গ্যাস পায় এবং তেমন কোনো উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারে, সেটা হবে দেশের জন্য আরও বড় খবর।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, তাঁদের ধারণা, ভোলায় কয়েক টিসিএফ পর্যন্ত গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আগামী দুই বছরে বাপেক্স যে ৩৬টি নতুন কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে, তার বাস্তবায়ন ভোলা থেকে শুরু করা হচ্ছে। সেখানে শিগগিরই দুটি নতুন অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে।

জ্বালানি নিরাপত্তা ও জ্বালানির প্রাপ্যতার দিক দিয়ে দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। এ কারণে ওই অঞ্চলে শিল্প ও বাণিজ্যের কোনো প্রসার ঘটেনি। ভোলার গ্যাস ওই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের এই বন্ধ্যত্বের অবসান ঘটাতে পারে।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতিকুজ্জামান বলেন, ভোলায় রিগ নেওয়ার কাজ শুরু করা হয়েছে। সেখানে বিদ্যমান চারটি কূপের মধ্যে দুটিতে (২ ও ৪ নম্বর) সংস্কারকাজ (ওয়ার্কওভার) করতে হবে। ওই কাজ শেষ করার পর অনুসন্ধান কূপ খনন শুরু করা হবে।

ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের ভিত্তিতে অনুসন্ধান কূপ খনন করার উদ্যোগকে সেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নতুন গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা হিসেবে দেখা যায় কি না, জানতে চাইলে আতিকুজ্জামান বলেন, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সব ক্ষেত্রেই কিছু অনিশ্চয়তা থাকে। শাহবাজপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে ‘লেটস হোপ ফর দ্য বেস্ট’ (আসুন, আমরা সবচেয়ে ভালো কিছুর আশা করি)।

ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রটি বেঙ্গল বেসিনভুক্ত এলাকায়। সেখানে যে ভূকাঠামোয় গ্যাস পাওয়া গেছে, তার ভূতাত্ত্বিক নাম ‘স্টেটিগ্রাফিক স্ট্রাকচার’। দেশের অন্য সব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে সুরমা বেসিনে। এই বেসিনের ভূকাঠামোয় ভূতাত্ত্বিক নাম ‘অ্যান্টি ক্লেইন স্ট্রাকচার’।

ভোলায় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য প্রথমে দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালানো হয় ১৯৮৬-৮৭ সালে। তাতে গ্যাসের অবস্থান চিহ্নিত করার পর প্রথম অনুসন্ধান কূপটি খনন করা হয় ১৯৯৪ সালে। এরপর আরও তিনটি কূপ খনন করা হয়েছে। এই কূপগুলো থেকে বর্তমানে ভোলায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে (২২৫ ও ৩৫ মেগাওয়াট) গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকদেরও গ্যাস দেওয়া হচ্ছে।

গত বছর বাপেক্স সেখানে ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালায়। শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় এই জরিপ চালানো হয়। এই জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করেই নতুন গ্যাসের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। বাপেক্স সূত্র বলেছে, এখন কূপ খননসহ ক্ষেত্রটি উন্নয়নে বাপেক্সের প্রধান সমস্যা আর্থিক অনটন ও জমি অধিগ্রহণ।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকার ইতিমধ্যে ওই দুটি সমস্যাই সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া বাপেক্সের কাছ থেকে পেট্রোবাংলা যে গ্যাস কিনছে, তার দাম বাড়িয়ে দেওয়া এবং বাপেক্সের লভ্যাংশ বাড়ানোরও নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দেশে এখন পর্যন্ত গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে মোট ২৮ টিসিএফের মতো। এখন পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে এর প্রায় অর্ধেক। বর্তমানে প্রতিবছর দেশে গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে ৮০০বিসিএফের মতো। তবে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা হলে তা এক টিসিএফে উন্নীত হতে পারে। সে হিসাবে অব্যবহৃত প্রায় ১৪ টিসিএফ গ্যাস দিয়ে আগামী ১৪ বছরের বেশি চলবে না।

তবে আশার কথা, দেশের স্থলভাগের ভূগর্ভে এখনো এমন অনেক সম্ভাবনাময় এলাকা রয়েছে, যেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস আছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। পেট্রোবাংলা ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের করা যৌথ জরিপে দেশের স্থলভাগে ৪২ টিসিএফ গ্যাসের অবস্থান আছে বলে বলা হয়েছে। পেট্রোবাংলার হাইড্রোকার্বন ইউনিট ও নরওয়ে সরকারের আরেকটি যৌথ জরিপে বলা হয়েছে প্রায় ৪২ টিসিএফ গ্যাসের অবস্থানের কথা।

দেশের সমুদ্রসীমায়ও তেল-গ্যাস পাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে সমস্যা হচ্ছে, তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম এখন পর্যন্ত সীমিত ও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কোম্পানি (বাপেক্স) ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করে গ্যাসের এই অবস্থান চিহ্নিত করেছে



মন্তব্য চালু নেই