বিদায়ী বছরে হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্র

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিচ্ছে একটি বছর। বিদায়ের খেরোখাতায় হিসেব কষে দেখেছি হারানোর তালিকাটা কম দীর্ঘ নয়। ২০১৬ সালে আমরা হারিয়েছি বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নক্ষত্র। চোখ মুছে মুখে হাসি আনলেও সে বেদনা ভোলার নয়। ভুলতে পারি না। তাই তো বর্ষ বিদায়ের লগ্নে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি তাঁদের। যারা বিদায়ী বছরে চলে গেলেন তাদের স্মৃতির উদ্দেশে আজকের এই নিবেদন।

কায়সুল হক
২০১৬ সালে আমরা হারিয়েছি কবি কায়সুল হককে। ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ৮৩ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।

কবি কায়সুল হক ১৯৩৩ সালের ২৯ মার্চ অবিভক্ত বাংলার মালদহে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম দবিরউদ্দিন আহমদ ও মা জিন্নাতুননেসা। তার পৈতৃক নিবাস রংপুর। তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কেটেছে পিতৃভূমিতে। কর্মজীবন কেটেছে ঢাকায়। ১৯৫০ সালে দৈনিক আজাদে তার প্রথম কবিতা ‘আজ’ প্রকাশিত হয়। পঞ্চাশের দশকের বিউটি বোর্ডিং সাহিত্যচক্রের অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি।

তার প্রকাশিত গ্রন্থ- শব্দের সাঁকো, রবীন্দ্রনাথের নিরুপম বাগান, আলোর দিকে যাত্রা, অনিন্দ্য চৈতন্য, অধুনা, সবার পত্রিকা, কালান্তর ও শৈলী।

কবিতায় অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০০১), সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫), ড. আসাদুজ্জামান সাহিত্য পুরস্কার (২০০০) লাভ করেন।

রফিক আজাদ
‘ভাত দে হারামজাদা- তা নাহলে মানচিত্র খাব’খ্যাত কবি রফিক আজাদও চলে গেলেন ২০১৬ সালে। তিনি ১২ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করেন।

কবি রফিক আজাদ ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার জন্মগ্রহণ করেন। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মরণে খালি পায়ে মিছিল করেন। চিরদিন প্রতিবাদী এই কবি তার দ্রোহকে শুধু কবিতার লেখনীতে আবদ্ধ না রেখে ১৯৭১ সালে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ।

কর্মজীবনে রফিক আজাদ বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’র সম্পাদক ছিলেন। ‘রোববার’ পত্রিকাতেও রফিক আজাদ নিজের নাম উহ্য রেখে সম্পাদনার কাজ করেছেন। এছাড়া টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনাও করেছেন তিনি। দৈনিক আমাদের সময়ের ভাষা বিষয়ক উপদেষ্টা সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

রফিক আজাদের প্রকাশিত গ্রন্থ- ‘অসম্ভবের পায়ে’, ‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ প্রভৃতি।

কাব্যের জন্য ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক পান তিনি। এছাড়া হুমায়ুন কবির স্মৃতি (লেখক শিবির) পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন।

নূরজাহান বেগম
বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নূরজাহান বেগম ২০১৬ সালের ২৩ মে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।

নূরজাহান বেগমের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুর জেলার চালিতাতলী গ্রামে। তার বাবা ১৯১৮ সালে কলকাতা থেকে মাসিক সওগাত পত্রিকা বের করেন।

নূরজাহান বেগম সম্পাদিত ‘বেগম’ বাংলার নারীদের প্রথম সাপ্তাহিক। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতা থেকে এটি প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে বেগম চলে আসে ঢাকায়। বেগম-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এবং প্রথম সম্পাদিকা ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। তবে চার মাস পর থেকেই পত্রিকাটির সম্পাদনা শুরু করেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও ফাতেমা খাতুনের একমাত্র মেয়ে নূরজাহান বেগম।

নূরজাহান বেগম স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। বাবার পরে নূরজাহান বেগমের পাশে দাঁড়ান তার স্বামী কচিকাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খান। নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি সুফিয়া কামালসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি থেকে বড় হয়েছেন নূরজাহান বেগম। ২০১১ সালে নূরজাহান বেগম সাংবাদিকতায় একুশে পদক পান।

মহাশ্বেতা দেবী
দুই বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী চলে গেলেন ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই। দক্ষিণ কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে ৯১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মহাশ্বেতা দেবী ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের ঢাকার এক শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মণীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল যুগের বিশিষ্ট কবি এবং সাহিত্যিক। তার কাকা ঋত্বিক ঘটক ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক। মা ধারিত্রী দেবীও একজন প্রসিদ্ধ লেখিকা ও সমাজসেবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

ঢাকায় স্কুল জীবন শেষ করেন তিনি। এরপর দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এপারে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তি নিকতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি নিয়ে স্নাতক হন, এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর লাভ করেন।

পড়াশোনা শেষ করে বিশিষ্ট নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। কিন্তু সেই বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। ১৯৫৯ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তাদের। তার একমাত্র ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্যও বাংলা সাহিত্যের একজন সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক ছিলেন। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে তিনিও মারা যান।

সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৯ সালে তিনি পান সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। ১৯৮৬ সালে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন, ১৯৯৬ সালে পান জ্ঞানপীঠ, ১৯৯৭ সালে রমণ ম্যাগসেসাই পুরস্কার, ২০০৬ সালে ভারত সরকারের পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হন, ২০১০ সালে যশবন্তরাও চ্যবন জাতীয় পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে ২০১১ সালে পান বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার।

শহীদ কাদরী
বাংলা ভাষার অন্যতম কবি শহীদ কাদরী ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট সকালে নিউ ইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

শহীদ কাদরী ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- ‘উত্তরাধিকার’, ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’, ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’, ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’প্রভৃতি।
শহীদ কাদরী ১৯৭৮ সালে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান। প্রথমে জার্মানি, পরে লন্ডন এবং বেশ কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন।

শহীদ কাদরী ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি ও ২০১১ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

সৈয়দ শামসুল হক
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এই কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব ৮১ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন

সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সৈয়দ হক কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, গান, চলচ্চিত্রসহ সাহিত্যের সব শাখায় অসামান্য অবদান রাখেন।

তার খেলারাম খেলে যা, নীল দংশন, মৃগয়া, সীমানা ছাড়িয়ে, আয়না বিবির পালাসহ বহু জনপ্রিয় বই রয়েছে। তার লেখা দুটি অমর নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ও নুরুল দীনের সারাজীবন।

বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন।

হারানোর বেদনা সয়ে আমরা নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় হয়তো মেতে উঠবো। তবু তাদের স্মৃতি আমাদের প্রতিনিয়তই বেদনাবিধুর করে তুলবে। তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।



মন্তব্য চালু নেই