বিএনপি-জামায়াতে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’

মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন শীর্ষ নেতাদের মুক্তির আন্দোলনে বিএনপির সমর্থন না পাওয়া, নেতাদের ফাঁসির রায় ও তা কার্যকর হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখানোয় বহুদিন ধরেই ক্ষোভ রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর।

তার ওপর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার ‘একলা চলো মনোভাব’ যেন আগুনে ঘি ঢেলেছে। শরীকের সাথে কোনো ধরনের কথাবার্তা না বলেই আন্দোলন থেকে বিএনপির সরে আসা ও নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় ক্ষুব্ধ জামায়াতে ইসলামীর অনেকে। এ সব নিয়ে দুই দলের নেতাদের মধ্যে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ।

জামায়াতের বিরুদ্ধেও ক্ষোভের কমতি নেই বিএনপিতে। বিশেষ করে গত টানা অবরোধ ও হরতালে জামায়াতকে সেভাবে মাঠে না পাওয়ায় তাদের ওপর বেজায় গোস্‌সা বিএনপির নেতাকর্মীরা।

ফলে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মাঠে ‘পরীক্ষিত বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে চলছে পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ, রয়েছে রাগ, ক্ষোভ।

প্রায় তিন মাস ধরে চলা টানা অবরোধ কর্মসূচির শেষের দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আদালতে আত্মসমর্পণের পর জামিন পান। জামিন শেষে তিনি গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে না গিয়ে সরাসরি বাসায় চলে যান। এ নিয়ে জোটের কয়েকটি দলসহ ক্ষুব্ধ জামায়াতে ইসলামী। তারা প্রথমদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণও করতে চায়নি।

শেষ পর্যন্ত বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে জামায়াতও নির্বাচনমুখী হয়। দলটি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৫০ জনের বেশি প্রার্থী দাঁড় করায়। এর মধ্যে কেউ কেউ হালি হালি মামলার কারণে সরে পড়েছেন। কারওবা প্রার্থীতাই বাতিল হয়েছে। এখনও জামায়াত সমর্থিত ২৬ জন কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী মাঠে রয়েছেন।

প্রার্থীতা নিয়ে অনৈক্য

গত ১০ এপ্রিল বিএনপিপন্থী নাগরিকদের সংগঠন ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’ এর পক্ষ থেকে ২০দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র, কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে। তাতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের ৯৩টি সাধারণ ওয়ার্ডে ৮৫ জন এবং দুই সিটির ৩১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ২৯জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য নুরুল ইসলাম বুলবুলের অভিযোগ, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়নে কোনো আলোচনাই হয়নি। শরীকদের সঙ্গে কথাবার্তা ছাড়াই ২০ দলের প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।

জামায়াতের ঢাকা সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির এই আহ্বায়ক আরও অভিযোগ করেন, ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’-এর আহ্বায়ক প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ ও সদস্য সচিব শওকত মাহমুদ স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ২০ দলের কাউন্সিলর প্রার্থীদের নামের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সেই তালিকা সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামী অবহিত নয়। এ বিষয়ে জোট নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে কোনো আলাপ আলোচনা করা হয়নি। এটা কোথা থেকে এবং কীভাবে এসেছে এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই জানা নেই।’

জামায়াত সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের তালিকা জানতে চাইলে বুলবুল বলেন, ‘আমাদের প্রার্থীরা মাঠে কাজ করছেন। খোঁজ-খবর নিলেই তাদেরকে পাবেন।’

জামায়াতের প্রার্থী

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর পদে ৫০ জনেরও বেশি জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। তবে তাদের মধ্যে অনেকেরই মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশনেরর বাছাইকালে বাতিল হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ দলীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থীতা প্রত্যাহারও করেন।

নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত বৈধ তালিকা ও স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর পদে জামায়াত ৩০ জনেরও বেশি প্রার্থীকে মাঠে নামায়। তবে বৃহস্পতিবার ওই তালিকা থেকে আরও কাটছাট করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে চূড়ান্তভাবে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৯ জন ও মহিলা কাউন্সিলর পদে ৭ জনসহ মোট ২৬ জনকে নির্বাচনী মাঠে রেখেছে ২০ দলের দ্বিতীয় বৃহৎ শরিক জামায়াত।

এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৯ জন, দক্ষিণে ১০ এবং মহিলা কাউন্সিলর পদে উত্তরে ৪ জন ও দক্ষিণে ৩ জন রয়েছেন।

খালেদার সাথেশরীকদের বৈঠক

নির্ধারিত সময়ে প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করায় প্রতি ওয়ার্ডেই বিএনপির একাধিক প্রার্থী রয়েছে। তার ওপর জামায়াতের প্রার্থী মাঠে থাকায় অনেকটা বেকায়দায় পড়বে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা।

জোট সূত্র জানায়, গত সোমবার রাতে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ২০ দলের শরিক কয়েকজন নেতা দেখা করেন। জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা না করেই সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী ঘোষণা করায় ‘জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়েছে’ এ নিয়ে কথা ওঠে সেখানে। এক পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।’

সেখানে উপস্থিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে এ বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে কথা বলতেও নির্দেশ দেন বেগম খালেদা জিয়া।

এ ব্যাপারে নজরুল ইসলাম খান বুধবার বিকেলে  টেলিফোনে বলেন, ‘এ ব্যাপারে মতামত দেওয়ার আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ না।’ এরপরই টেলিফোন সংযোগ কেটে দেন তিনি। পরে আর ফোন ধরেননি তিনি।

জোট সূত্র জানায়, কাউন্সিলর প্রার্থী নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে টানাপোড়েন নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আলোচনার ভিত্তিতে কয়েকটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদ জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে।

শীতল সম্পর্কের শুরু যেভাবে

বিএনপি-জামায়াত সূত্র জানায়, জোটের বড় দুই শরিক বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল অনেক দিন থেকেই। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া রায় সম্পর্কে বরাবরই বিএনপির ‘রহস্যজনক নীরবতা’ এবং জামায়াতের ডাকা হরতালে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন না জানানোয় বেশ ক্ষুব্ধ হয় রাজনৈতিকভাবে চাপে থাকা দলটি।

এ নিয়ে বিভিন্ন সময় জামায়াতের মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতা বা সমর্থক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির সমালোচনা করলেও শীর্ষ নেতারা বরাবরই নিশ্চুপ থেকেছেন।

সর্বশেষ, গত ১১ এপ্রিল মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। এ নিয়ে জামায়াত তিনদিনের (আগে-পরে) হরতাল কর্মসূচি পালন করলেও বিএনপি বরাবরের মতই চুপ থেকেছে।

এ নিয়ে কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী গত ১২ এপ্রিল  বলেন, ‘আব্বা (কামারুজ্জামান) বিএনপি জোটে জামায়াতের থাকা না থাকা নিয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু বিএনপি যে এ্যাক্টিভভাবে জামায়াতের পক্ষে কথা বলেনি এ নিয়ে সমালোচনা করেছেন। আমরা কিংবা আব্বা এটা চাইনি যে, তারা বলুক বিচার মানি না।

বিচারটা যে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ হয়েছে, এটাই তারা সব জায়গায় বলতো। কিন্তু জোরালভাবে বলেনি তারা। শুরুর দিকে বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির কয়েকজন নেতা এ বিষয়ে কথা বললেও পরবর্তী সময়ে কারা কী বুদ্ধি দিয়েছে জানি না। তারা চুপচাপ থেকেছেন। এটা নিয়ে আব্বার অসন্তোষ ছিল। এ নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজনকে তিনি চিঠিও দিয়েছেন।’

এর আগে জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ না করা এবং কিছুদিনের মাথায় দলটির আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া নিয়ে বিএনপির নীরবতায়ও ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত। গোলাম আযম মারা যাওয়ার পর তার ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমী গত ২৮ অক্টোবর ফেসবুকে লেখেন, ‘গোলাম আযমের মৃত্যুতে শোক না জানিয়ে বিএনপি অকৃতজ্ঞের মত কাজ করেছে। জামায়াত ছাড়া বিএনপি কখনো ক্ষমতায় যেতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।’

সূত্র জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো জামায়াত ছাড়তে বিএনপিকে বারবার পরামর্শ দিচ্ছে। দলের মধ্যেও এ নিয়ে একটি অংশের চাপ রয়েছে। তবে বেগম খালেদা জিয়া সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না।

অন্যদিকে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বের ওপরও জোট ছাড়তে চাপ বাড়ছে দলের তরুণ নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে। তবে, জামায়াত বিএনপিজোট ছেড়ে নতুন করে আর ‘বেঈমানীর’ কাঁদা গায়ে মাখাতে চাচ্ছে না। বরং বিএনপির পক্ষ থেকে যদি জোট ছাড়তে বলা হয় তবেই তারা এককভাবে বা অন্যকোনো জোট গঠনে মনোযোগী হবে বলে জানা গেছে।

জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’ নামের বিএনপিপন্থী সংগঠনটি ঢাকার দুই সিটির ২০দলের কাউন্সিলর প্রার্থী ঘোষণা প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মে. জে.(অব.) মাহবুবুর রহমান  বলেন, ‘এ নিয়ে আমার বক্তব্য নাই। আমি বলবো ঘোষিত প্রার্থীদের পক্ষে ২০ দল কাজ করবে। তাদের সাথে শত নাগরিক কমিটি, সিভিল সোসাইটি এবং দুই মহানগরের ভোটার ও নাগরিকরা আছেন।’

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় জামায়াতের সঙ্গে আমাদের (বিএনপির) মিলিয়ে দেখা উচিত হবে না। কারণ তাদের আলাদা একটা পলিটিক্যাল এজেন্ডা আছে। বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের দল। আমরা মডার্ন গণতান্ত্রিক দলের অনুসারী। তাই বিএনপির সঙ্গে জামায়াতকে একসাথে মিলিয়ে দেখার সুযোগ নাই। ২০ দলে আরও ১৯টি দল আছে।’

তাহলে কী বলা যাবে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির নানা কারণে দূরত্ব বেড়েছে? এমন প্রশ্নে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘না-না অসুবিধা নাই। আমরা আপন আপন দলের গঠনতন্ত্র, রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনা নিয়ে আছি।’দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই