বিএনপি এখনো গুণছে ভুলের মাশুল

জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য বিএনপি নানামুখী চাপে রয়েছে। তবে জামায়াত ছাড়া নিয়ে বিএনপি এখনো দ্বিধায় রয়েছে। জামায়াত নেতাদের বিতর্কিত ভূমিকা আজ নতুন নয়।

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে দ্বিধায় ছিল বিএনপি। কিন্তু জামায়াতই সে সময় চাপ দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে নেয় বলে নিশ্চিত করেছেন দলটির নেতারা। আলোচনা আছে, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের কথা মতোই ‘নিশ্চিন্তে’ ২০০৮ সালের নির্বাচনে গিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

মুজাহিদ বলেছিলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন মাঠ পর্যায়ে চারদলীয় জোটের অবস্থা ভালো, তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই। তার ওই ভুল তথ্যের কারণে অনেকটা গা-ছাড়া ভাব দেখা গিয়েছিল বিএনপির নির্বাচনী শিবিরে। যেই ভুলের মাশুল বিএনপি এখনও গুনছে বলে মনে করেন দলটি।

ওই সময় নির্বাচনে ভরাডুবির কারণ খুঁজে বের করতে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বিভাগওয়ারী কমিটি করে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া।

ঢাকায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এসে ওই নির্বাচনে ভরাডুবির কারণ তুলে ধরেন কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। জোট সরকারের আমলে দুর্নীতি-অনিয়মের পাশাপাশি কর্মীদের মূল্যায়নে উঠে আসে জামায়াত প্রসঙ্গও।

নেতা-কর্মীরা জানান, জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধকালীন অবস্থান আর জঙ্গি তৎপরতায় দলের নেতাদের অংশগ্রহণ নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে নানা কথা আছে। তাছাড়া জোটে থেকেও বিএনপিকে দুর্বল করে নিজেরা লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে জামায়াত। সে সময় করা কমিটির প্রায় সবই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের বিষয়টি পুনর্মূল্যায়নে খালেদা জিয়াকে সুপারিশ করে। কিন্তু সে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় বিএনপি

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। তার আহ্বানে সাড়া দিয়েই দেশবাসী তখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিএনপি নেতারা এমন দাবি করে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের দল হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে পছন্দ করেন।

অথচ জামায়াতের সঙ্গে জোটের কারণেই দেশবাসীর প্রাণের দাবি যুদ্ধাপরাধের বিচারের শুরু থেকেই এর পক্ষে অবস্থান নিতে পারেনি বিএনপি। ‘আমরা বিচারের বিপক্ষে নই, কিন্তু বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের’Ñবিএনপির এমন অবস্থানের মানে কি তা কখনই পরিষ্কার করেনি বিএনপি।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জামায়াত নেতাদের বিচার, ট্রাইব্যুনাল বা আপিল বিভাগের রায় নিয়ে কথা না বলে দেশবাসী না চাইলেও একটি বার্তা দিয়ে ফেলেছে বিএনপি। তারা যে আসলে বিচারের পক্ষে নয় সে অবস্থানই দেশবাসীকে বিএনপি দিয়েছে বলে মনে করেন তারা।

মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখোমুখি জামায়াত নেতাদেরকে ‘রাজবন্দি’ বলে উল্লেখ করে ২০১৩ সালের শেষ দিকে ব্যাপক সমালোচনা কুড়িয়েছেন খালেদা জিয়া।

একই অপরাধে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের পরে সেভাবে প্রতিক্রিয়া না দেখালেও চট্টগ্রামে স্থানীয়ভাবে হরতাল ডেকেছিল বিএনপি। অন্যদিকে জামায়াতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার রায় ও রায় কার্যকর হওয়ার পরও এ নিয়ে তারা স¤পূর্ণ নীরবতা বজায় রাখে। আর এমন অবস্থানে বিএনপি-জামায়াত স¤পর্কেও ভাটা পড়ে। দারুণ ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত।

আবার জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুতেও স্বাধীনভাবে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে বিএনপির সামনে জামায়াত অন্তরায়। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে বিএনপি না পেরেছে মুখ খুলে কিছুই বলতে। আবার চুপ থাকাতেও বিরাগভাজন হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতারা নানা সময় প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে এসব বিষয় নিয়ে বিএনপির সমালোচনাও করেছে।

আবার দলের ভেতর আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের পক্ষে অবস্থান নিতে বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা।

বিচারের শুরুর দিকে মওদুদের এই বক্তব্যের কারণে সে সময় তার সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কের অবনতিও হয়। কিন্তু বিএনপির এই নেতা পরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মুখোমুখি জামায়াত নেতাদের বাঁচাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল বিভাগে শুনানিতে অংশ নেন। খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন মুক্তিযুদ্ধের পর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন। সেই নেতাই এখন দলের অবস্থানের কারণেই কি না, আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবীতে পরিণত হয়েছেন।

বিএনপি নেতারাও মনে করেন, বিএনপির এখন যত দোষ সব জামায়াতকে ঘিরে। বিশেষ করে সরকার যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াত নেতাদের বিচার শুরুর পর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এনিয়ে কথা বলার ভালো সুযোগ পেয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে বিএনপির সখ্য এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে তারা জনগণের মধ্যে কিছুটা হলেও অবস্থান করতে পেরেছে।

দলের স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য লে. জেনারেল মাহবুর রহমান বলেন, ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একটি সেক্টরের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তার দলকে যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক দল বললে মুক্তিযুদ্ধকেই অপমান করা হয়।’ বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যে সম্পর্ক তা নেহাত নির্বাচন কেন্দ্রীয় রাজনীতির জন্য। জামায়াতের আলাদা সংবিধান ও কার্যবিধি আছে। বিএনপিরও সবকিছু আলাদা। কারো সঙ্গে কারো কোনো মিল নেই। শুধু শুধু বিএনপির সঙ্গে জামায়াতকে মিলিয়ে ফেলা অন্যায়।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি জামায়াতনির্ভর হয়ে গেছে এটা পুরোপুরি সত্যি নয়। তবে জামায়াতকে জোটে রেখে আমরা যে বেশি লাভবান হইনি এটা সত্যি।’ সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।



মন্তব্য চালু নেই