বিএনপিতে ‘বেইমান’ কারা?

সংস্কারবাদী, আঁতাতকারী ও সুবিধাবাদীদের দলে জায়গা না দিতে সব সময়ই সোচ্চার বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপি-প্রধানের সামনেই এসব নেতাকে ‘বেইমান’ আখ্যা দিয়ে তাদের ব্যাপারে চেয়ারপারসনকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন কাউন্সিলররা। খালেদা জিয়াও তৃণমূলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নতুন কমিটিতে ‘বেইমান’দের জায়গা হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

শনিবার রাতে রাজধানী ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশনে দলের সাংগঠনিক প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনায় বক্তব্য দেন জেলা ও উপজেলা থেকে আসা কাউন্সিলররা। সবশেষ দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বক্তব্য দেন।

সরকারবিরোধী আন্দোলনে যেসব কেন্দ্রীয় নেতা নিষ্ক্রিয় ছিলেন বা নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বেশির ভাগ কাউন্সিলর বক্তা। তারা জানতে চান ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগের আন্দোলন হঠাৎ বন্ধ করার কারণ। পাশাপাশি সংস্কারবাদী, বেইমান, মীরজাফরদের নতুন নির্বাহী কমিটিতে জায়গা না দেয়ার জোর দাবি করেন তারা।

এ সময় হল রুমের ভেতরে ও বাইরে থাকা কয়েক হাজার নেতাকর্মী হাততালি দিয়ে এসব বক্তব্য সমর্থন করেন।

তৃণমূলের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরে যখন খালেদা জিয়া অনেকটা তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বক্তব্য দেন, তখন উপস্থিত নেতাকর্মীরা ‘ঠিক’ ‘ঠিক’ বলে উল্লাস করেন।

খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের সময় হলরুমের বাইরে থাকা নেতাকর্মীদের মধ্যে কৌতূহল প্রকাশ ও বলাবলি হচ্ছিল- কারা এই বেইমান? ম্যাডাম কাকে বেইমান বোঝাতে চেয়েছেন?

কাউকে কাউকে বাইরে লাগানো পর্দায় সম্মেলন মঞ্চে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ও পেছনে বসা কেন্দ্রীয় কিছু নেতার ছবির দিকে ইঙ্গিত করতে দেখা যায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের অনেকে মঞ্চে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন।

তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে, কাউন্সিলররা তাদের বক্তব্যে ‘বেইমান’, ‘মীরজাফর’ হিসেবে এক-এগারোর সময়ে সংস্কারবাদীদের চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে গত আন্দোলনে যেসব নেতা খালেদা জিয়াকে মাঠে থাকার আশ্বাস দিয়ে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে আত্মগোপনে গিয়েছিলেন তাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

কাউন্সিলরদের মধ্যে প্রথম বক্তা দলের স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক ও নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেন, “ম্যাডাম, যারা বিগত দিনে বেইমানি করেছে, আপনি নির্দেশ দিলে ১৫ দিনের মধ্যে সরকার পতন ঘটাবে বলে আশ্বাস দিয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছিল, তাদের চিহ্নিত করতে হবে।”

আর একজন আকন কুদ্দুসুর রহমান খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেন, “বেইমান, মীরজাফরদের নতুন কমিটিতে দেখতে চাই না। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বেইমানি করেনি। যদি বেইমানদের চিনতে চান তাহলে আশপাশ আর পেছনে তাকালে দেখতে পারবেন।”

তিনি তৃণমূলের পদ দেয়ার ক্ষেত্রে আমলনামা হিসেবে এক-এগারোর সময় এবং বিগত আন্দোলনে কার কী ভূমিকা ছিল তা মূল্যায়নের দাবি জানান।

তৃণমূলের নেতাদের এমন বক্তব্যের সময় কেন্দ্রীয় অনেক নেতা থ বনে যান। কারণ উপস্থিত কেউ কেউ সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত। অনেকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে আত্মগোপনে থাকার অভিযোগও আছে।

নেতাদের এমন বক্তব্যের পর চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভবিষ্যতে যোগ্য ও পরীক্ষিতদের দলে জায়গা দেয়ার কথা ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে বিএনপিতে বেইমান, মীরজাফর আছে বলে কাউন্সিলরদের বক্তব্যের সঙ্গে সুর মেলান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “এরশাদ ছিয়াশিতে বেইমানি করেছিলেন। আমাদের দলের মধ্যেও এমন কিছু বেইমান আছেন, যাদের জন্য আন্দোলনে সেভাবে সফলতা আসেনি। মীরজাফরের রক্ত তো অনেকের মধ্যেই আছে।

বেইমানদের বাদ দিতে হবে।…বিএনপিতে লোকের অভাব হবে না। অনেকেই বিএনপিতে আসতে চায়। আমি বলেছি, আগে কাউন্সিল করি, পরে সময়-সুযোগ বুঝে আসতে বলা হবে।”

বিএনপির নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে দলের পরিকল্পনার খবর পৌঁছে দেয়ার। নেতাকর্মীদের মুখে মুখে ফেরা খবর হলো, খালেদা জিয়ার আশপাশেই এসব আঁতাতকারীর অবস্থান।

২০১২ সালে দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষ থেকে কলমসদৃশ ১৮টি গোপন ক্যামেরা, অডিও-ভিডিও ডিভাইস উদ্ধার করার ঘটনা সবার জানা। বিএনপির অভ্যন্তরীণ গোপন খবর ও তথ্য ফাঁসের উদ্দেশ্য এগুলো রাখা হয়েছিল বলে তখন অভিযোগ উঠেছিল। আর ওই অভিযোগের তীর ছিল চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত ও কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে।

দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্য নিয়ে জানতে চাইলে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করছেন শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ।

তবে বিএনপির খুলনা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, “আন্দোলনে থাকার আশ্বাস দিয়েও যারা ছিলেন না,নেতাকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন, চেয়ারপারসন তাদের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন বলে আমি মনে করি।”

নতুন কমিটিতে চেয়ারপারসনের বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটবে এমন প্রত্যাশা করে মঞ্জু বলেন, “এই বক্তব্য নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে, যা আগামী দিনের আন্দোলনে ফল দেবে।” ঢাকাটাইমস।



মন্তব্য চালু নেই