বিএনপিকে কোণঠাসা করতে আগাম নির্বাচন দিতে পারে আওয়ামী লীগ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপিদের প্রস্তুতি নেওয়ার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে ‘সাদামাটা’ উক্তি বলে মনে করছেন না আওয়ামী লীগের সিনিয়র বেশ কয়েকজন নেতা। তাদের একজন বলেন, নির্বাচনি মাঠে এমপির নেতৃত্বে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচার চালাবে।

আরেকজন নেতা মনে করেন, এ নির্বাচনে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিএনপিকে অংশগ্রহণ করতে হবে, এতে যুক্ত না হলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে তারা। একই ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে।

ক্ষমতাসীনরা আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে বলে মনে করছেন সরকারের ঘনিষ্ঠরা।

তাদের মতে, এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও শুরু করেছে। শেখ হাসিনা নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে দলের তরুণদের সুযোগ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া করছেন। অপেক্ষা শুধু ‘যুতসই’ সময়ের। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের ভেতর সন্ত্রাসী ও নাশকতার প্রায় ১০০টি মামলার রায় হয়ে যেতে পারে। পেট্রলবোম নিক্ষেপ, মানুষ হত্যা, অগ্নিসংযোগ, বোমা-বিস্ফোরকসহ নাশকতার বেশকিছু চাঞ্চল্যকর অপরাধের বিচার হয়ে যাবে।

জাতীয় সংসদে দেওয়া ভাষণে এসএসএফের (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনাকালে গণভবনের সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব বাংলাদেশের পাশে আছে। এরপরই এমপিদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিএনপির একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে দলটির সাংগঠনিক অবস্থা ভালো নয়। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠে নির্বাচনে জয়ের জন্য কাজ করা দলের নেতাকর্মীদের পক্ষে সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতাদের অনেকেরই শাস্তি হতে পারে। এছাড়াও তরুণ কয়েকজন নেতার নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে ছাড়াই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। এতে দেশি-বিদেশি অনেকের কাছে এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এরপর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে আশ্বস্ত করা হয়, তাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় এমন একটি নির্বাচন করতে হয়েছে।

তবে সব দলের অংশগ্রহণে তারা পরবর্তী নির্বাচন করতে চায়। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহলের একাধিক সিনিয়র নেতা বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হবে। তার আগেই ‘সুবিধাজনক’ সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে আগাম নির্বাচন হলেও নির্বাচনি মাঠ তৈরিই আছে।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ ক্ষমতাসীন দলটির একটি অংশ নির্ধারিত সময়ের আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পক্ষে বলে জানা গেছে।

তবে দেশি-বিদেশি চাপ সত্ত্বেও সরকারের শীর্ষ মহল বরাবরই বলে আসছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়েই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ অবস্থায় মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় এমপিদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, সরকারের মেয়াদ আছে আর ২ বছর ৩ মাস। এই সময়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে দলীয় এমপিদের কাজ করার আহ্বান জানান।

প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে বাইরে রেখে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ বিতর্কিত হবে বলে মনে করেন না সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তারা মনে করেন, রাজনীতিতে বেকায়দায় থাকা বিএনপি এবার নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হবে। দলের স্বার্থে এবং অস্তিত্বের স্বার্থে আগাম কিংবা নির্ধারিত সময়ের নির্বাচনে অংশ নেবে।

বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার প্রক্রিয়া হিসাবেই আগাম নির্বাচন করা হতে পারে কী-না এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, আগাম নির্বাচন হবে বলে আমি মনে করি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলাকায় গিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা ও জঙ্গিবাদবিরোধী সভা করার নির্দেশনা দিয়ে মূলত জাতীয় ঐক্যকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন।
আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, এটা হচ্ছে শোনা কথা। আর শোনা কথায় আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেছেন, কোনো দলকে বাইরে রেখে নির্বাচন করব না বা এমন ইচ্ছাও আমাদের নেই। বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে চাই তাও না। ২০১৪ সালের আগে বিএনপি চেয়ারপারসনকে আমাদের দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় তাদের দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত জোট দেশে মানুষ পুড়িয়ে মারার তা-ব চালালো।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট হুমায়ুন বলেন, মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো প্রয়োজন পড়েনি। এছাড়া জঙ্গিবাদ একটি ইস্যু। আমার মনে হয় নির্বাচনি এলাকায় গিয়ে জঙ্গিবিরোধী সমাবেশ করা ও নির্বাচন করার জন্য তৈরি হওয়ার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেছেন।

কাউকে বাইরে রেখে নির্বাচন করার চিন্তা থেকে দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন কথা বলেননি বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন। আগাম নির্বাচন প্রক্রিয়া ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাজ আরও জোরদার এবং জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধের জন্যই নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলেছেন তিনি।



মন্তব্য চালু নেই