বাস মালিকরাও যে কারণে শ্রমিকদের ধর্মঘটে নামিয়েছিলেন

পূর্বঘোষণা ছাড়াই যাত্রীদের জিম্মি করে দুই দিনের পরিবহন ধর্মঘটের নেপথ্যে বাস মালিক সংগঠনের নেতারাও জড়িত ছিলেন?—এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মাঝে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, শ্রমিকদের কাঁধে বন্দুক রেখে সরকারকে চাপে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে উঠেপড়ে লেগেছিলেন কতিপয় পরিবহন নেতা। যদিও বাস মালিকরা এই ধর্মঘটের দায়ভার এককভাবে শ্রমিকদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।খবর বাংলা ট্রিবিউনের।

ধর্মঘটের পেছনে বাস মালিকদের জড়িত থাকার কারণ হিসেবে পরিবহন মালিক সমিতির একটি সূত্র জানায়, দুর্ঘটনায় দায়ী চালকদের কী শাস্তি হচ্ছে, মালিকদের কাছে সেটা বড় ছিল না। বড় বিষয় ছিল দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ মামলা থেকে নিজেদের বাঁচানো। কারণ এ পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে, তার একটিতেও ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। বরং প্রভাবশালীদের সঙ্গে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সামান্য কিছু দিয়ে অথবা কাউকে কিছু না দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে দুর্ঘটনার মামলা থেকে রেহাই পেয়ে গেছেন পরিবহন মালিকরা।

জানা গেছে, দুর্ঘটনার পর যখন পরিবহন মালিকদেরই আধিপত্য চলছিল, ক্ষতিগ্রস্তরা কোনও ক্ষতিপূরণ পাচ্ছিলেন না, তখন ২০০৫ সালের ২০ মার্চ ঢাকার একটি নিম্ন আদালত সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর পরিবারকে তিন কোটি ৫২ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে নির্দেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। এরপর কোম্পানির পক্ষ থেকে আপিল করা হলে ২০১০ সালের ১১ মে নিম্ন আদালতের রায় সংশোধন করে দুই কোটি তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের বিরুদ্ধে নিহত মন্টুর পরিবারের পক্ষ থেকে আপিল দায়ের করা হয়। ২০১৪ সালের ২০ জুলাই আপিল বিভাগ নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন। দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশে এটাই ছিল প্রথম সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ মামলার রায়।

উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালে দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু মতিঝিলের আনন্দ ভবন কমিউনিটি সেন্টারের সামনে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন। ১৯৯১ সালে তার স্ত্রী রওশন আরা বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবিতে মামলা দায়ের করেন।

জানা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার আরও কয়েকটি ক্ষতিপূরণের মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ জনের নিহত হওয়ার ঘটনায় মানিকগঞ্জের আদালতে ৭ কোটি ৭৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৫২ টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলার বাদী নিহত তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। গত বছর মামলাটি হাইকোর্টে স্থানান্তর করা হয়েছে। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচ জন নিহত হন।

ক্ষতিপূরণ মামলা চলছে সিলেটের আদালতেও। জানা গেছে, ২০১২ সালের ১১ মে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ওসমানী নগরের তেরমাইলে গ্রিন লাইন পরিবহনের সঙ্গে পাথর বোঝাই একটি ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত হন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ইফতেখার হোসেন শামীমসহ ৮ জন। এ ঘটনায় ১৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে সিলেটের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে নিহতের স্ত্রী নাজনীন হোসেন ও তার মেয়ে শেহজিন ওয়াজিহা হোসেন, ছেলে ইনতেখাব হোসেন ও ইশরাত হোসেন বাদী হয়ে দু’টি মামলা করেন। মামলা দু’টি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

ক্ষতিপূরণ মামলা প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ থাকলে এ ধরনের মামলায় আবেদনকারীর পক্ষে ক্ষতিপূরণ পাওয়া সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে ক্ষতির হিসাব করে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন আদালত।’

জানা গেছে, ক্ষতিপূরণ মামলার একটি চূড়ান্ত রায় এবং অন্যগুলো বিচারাধীন থাকায় পরিবহন মালিকদের টনক নড়ে। আগামীতে এ ধরনের রায় ঠেকাতে সরকারকে চাপে রাখার সুযোগ খুঁজতে থাকেন তারা। সোমবার রাতে সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেন তারা।

পরিবহন মালিকদের এই তৎপরতার প্রমাণ পাওয়া যায় বুধবার মতিঝিলের পরিবহন ভবনে অনুষ্ঠিত পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার কারণে ফাঁসি বা যাবজ্জীবন সাজা হওয়ার আশঙ্কায় শ্রমিকরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গার ডিলাক্স ও গ্রিনলাইনের দুর্ঘটনার কারণে একটিতে ১২ কোটি ৮৮ লাখ ও অন্যটিতে ২০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। আমাদের আশঙ্কা, এ দু’টি মামলাও আমাদের বিরুদ্ধে হবে। সব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই আমাদের এগুতে হচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচ জন এবং সাভারে এক নারীর নিহত হওয়ার ঘটনার দুই মামলায় এক চালকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অন্য চালকের ফাঁসির আদেশ দেন মানিকগঞ্জ ও ঢাকার আদালত। এতে সংক্ষুব্ধ হয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা প্রথমে (রবিবার-সোমবার) খুলনা অঞ্চলের দশ জেলায়, পরে মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ভোর থেকে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট শুরু করেন।

সোমবার রাতে পরিবহন সেক্টরের বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে মিন্টো রোডে অবস্থিত নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বাসভবনে মালিক-শ্রমিক নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে ধর্মঘট পরিস্থিতি, চালকদের সাজা ও ক্ষতিপূরণ মামলাগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মালিক সমিতির একজন নেতা বলেন, ‘এই আলোচনার এক পর্যায়ে শ্রমিকদের পরিবহন ধর্মঘটে যেতে উস্কে দেওয়া হয়। এই ধর্মঘটের উদ্দেশ্যই ছিল, চালকদের শাস্তির বিধান শিথিলসহ ক্ষতিপূরণ মামলার রায় নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।’

পরিবহন সেক্টরের বৃহৎ দুটি সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির নেতা এই ধর্মঘটকে শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত কর্মবিরতি বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াস চালান। কিন্তু বুধবার (১ মার্চ) সরকারের চাপে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে পরিবহন নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে শ্রমিকদের গাড়ি চালানোর আহ্বান জানিয়ে পরিবহন ধর্মঘটের অবসান ঘটান। এরপরই রাজধানীসহ সারাদেশে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসে।



মন্তব্য চালু নেই