“বাবা যাচ্ছে জলপথে”

মোঃ আমান উল্লাহ, কক্সবাজার থেকে: সর্বগ্রাসী মরন নেশা ইয়াবা যার স্থানীয় নাম বাবা। সেই বাবা এখন চিহ্নিত কিছু মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জলপথ দিয়ে নিরাপদে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। স্থলপথে আইনশৃংখলা বাহিনীর কঠোর তৎপরতার কারণে এখন জলপথকেই নিরাপদ হিসেবে বেছে নিয়েছে তারা। ফলে মাছ ধরার অভিনব কায়দায় গভীর সমুদ্রে গিয়ে মিয়ানমারের ট্রলার থেকে খালাস করে নিয়ে আসছে কোটি কোটি পিচ জীবনঘাতি ইয়াবা।

সম্প্রতি কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর কৌশলী তৎপরতার কারণে সামান্য কিছু ধরা পড়লেও নিরাপদে গন্তব্যে পৌছে যাচ্ছে অসংখ্য চালান। সম্প্রতি সেন্টমার্টিনের গভীর বঙ্গোপসাগর থেকে ১২ কোটি টাকা মূল্যের ৪ লাখ পিচ ইয়াবা ও দুটি ট্রলারসহ ১৯ জনকে আটকের পর এসব তথ্য বেরিয়ে আসছে। মিয়ানমারের শক্তিশালী ৫টি সিন্ডিকেট মাছ ধরার ট্রলারযোগে প্রতি সপ্তাহে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের সমুদ্রপথে ইয়াবার চালান পাঠাচ্ছে। এসব চালান খালাস হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ সারা দেশে।

আটককৃত ১৯জনের মধ্যে কালা বাম্বু নামের একজন ইয়াবা সম্রাটও রয়েছেন। তিনিসহ আটক বাকিদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা কিভাবে এবং কাদের নেতৃত্বে সমুদ্রপথে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে আসেন সেসব বিষয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।

জানা যায়, মিয়ানমার হতে ইয়াবার বড় চালান আসার সংবাদ পেয়ে ওইদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সেন্টমার্টিন কোস্টগার্ড ষ্টেশন কমান্ডার লে. ডিকসন চৌধুরীর নেতৃত্বে সেন্টমার্টিনের অদূরে দক্ষিণ-পূর্ব পাশে অভিযান চালায় কোস্টগার্ড। তারা বিপূল পরিমাণ ইয়াবা বড়ি, ২টি ফিশিং ট্রলারসহ টেকনাফ লেঙ্গুরবিলের আমির হামজার ছেলে শামসু, জাহিদ হোসেনের ছেলে আজিজুল (২২), নুর হোছনের ছেলে মকবুল (২৫), আবুল হোছনের ছেলে অজি উল্লাহ (২২), জকির আহমদের ছেলে জাহিদ হোছন (৩০), নবী হোসেনের ছেলে রুবেল (২৫), আব্দুল মালেকের ছেলে আনোয়ার হোসেন (২৪), তৈয়ব হোছনের ছেরে আব্দুল্লাহ (১৮), আব্দুল মোনাফের ছেলে আইয়ুব আলী (২৪), জাহাঙ্গীর আলম (৩২), লেঙ্গুরবিলের আব্দুর রাজ্জাকের পুত্র রুবেল (১৮) ও রাশেদুল হক (২৬) লম্বরীর আব্দুর রহিমের ছেলে ফজলুল করিম (২৭), হাবিবুর রহমানের ছেলে ইলিয়াছ (২৫), নুরুল হকের পুত্র খাইরুল আমিন, সাবরাং আলী আহমদের ছেলে ঈমাম হোসেন (৩৫), মৌলভীপাড়ার আব্দুস সালামের পুত্র নুর আলম (২৫) কে আটক করে। পরে গণনা করে ১২ কোটি টাকা মূল্যের ৪ লাখ পিস ইয়াবা বড়ি পাওয়া যায়। আটককৃতদের সংশ্লিষ্ট মামলায় টেকনাফ মডেল থানায় সোর্পদ করে পরে কক্সবাজার আদালতে পাঠানো হয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা প্রথম জিজ্ঞাসাবাদেই ফিশিং ট্রলারটির কোল্ড স্টোরের ভেতর বিপুল ইয়াবা ট্যাবলেট থাকার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করে এবং বড় বড় রাঘব বোয়ালদের নামও আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে বলে দেয়।

কোস্টগার্ড টেকনাফ ষ্টেশন কমান্ডার লে: কর্নেল ডিকসন চৌধুরী বলেন, আটককৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা কিভাবে সমুদ্রপথে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে আসে সে বিষয়ে পুলিশকে নানা তথ্য দিয়েছে। তাদের তথ্যের ভিক্তিতে রাঘব বোয়ালদের ধরতে গোয়েন্দা ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বিভিন্ন বিভাগ মাঠে কাজ চালাচ্ছে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, এসব ইয়াবা তারা বিএনপি নেতা আলম মেম্বার ও তার চক্রের হয়ে পাচার করছিল। সদর ইউনিয়নের লেঙ্গুরবিলে শাহ আলম ভুট্রো, ছৈয়দ আলম, তৈয়ব, দেলোয়ার হোসেন এ চক্রের সদস্য। এতদিন আলম মেম্বার ও তার ভাই এবং সহযোগীরা সবাই মিলে পাচারের কাজটি বাইরে থেকে করতো।

আটক শামসুদ্দিন ওরফে কালা বাম্বু বহুবার মিয়ানমার থেকে এ রকম বিপুল পরিমাণ ইয়াবার চালান নিয়ে এসেছেন। তার নেতৃত্বে ফিশিং বোট করে সমুদ্র পথে ইয়াবার চালান আনার পর আলম মেম্বারকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। পরে লেঙ্গুরবিল ও পাহাড়ী বিভিন্ন পয়েন্টে দিয়ে ইয়াবার চালান খালাস করে চক্রের সদস্যরা। গ্রেপ্তার হওয়া কালা বাম্বু ও আলম মেম্বার, শাহ আলম ভুট্রো, দেলোয়ার ও ছৈয়দ আলমের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় ও কক্সবাজার সদর মডেল থানায় ইয়াবা সংক্রান্ত মাদকের মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। এ সিন্ডিকেট সদস্যরা ইয়াবা পাচারের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে কয়েক বছর যাবৎ ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বাস করছেন চক্রের সদস্যরা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সাগর সীমান্তে ইয়াবা তৈরির জন্য গড়ে উঠেছে ৪০টি কারখানা। এখানে উৎপাদিত ইয়াবা স্থল ও নৌপথে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে দেশে। তবে বর্তমানে পাচারকারীরা নৌপথ কে নিরাপদ হিসেবে বেছে নিয়ে সুকৌশলে রাতের আঁধারে দেশে ঢুকাচ্ছে। এসব চালানের কিছু ধরা পড়লেও বেশির ভাগই চলে যাচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকার অভিজাত এলাকায়ও।

ইয়াবা পাচারের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের মূল হোতারা ব্যবহার করছে সাগরে যাওয়া গরু, গাছ ও মাছ ধরার ট্রলার এবং মাঝিমাল্লাদের। তারই বাস্তবতা আলম মেম্বার গং এর ফিশিং বোর্টসহ ৪ লক্ষ ইয়াবা ও ১৯ মাঝিমাল্লাকে আটক।



মন্তব্য চালু নেই