বাংলা সন সৃষ্টি হয়েছে হিজরি সন থেকে!

বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ বাংলাদেশ এবং ভারত বর্ষের একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত সৌরপঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌরদিন গণনা শুরু হয়। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে মোট ৩৬৫ দিন কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। এই সময়টাই এক সৌর বছর। গ্রেগরিয়ান সনের মতো বাংলা সনেও মোট ১২ মাস। এগুলো হল বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। বাংলা সন শুরু হয় পহেলা বৈশাখ বা বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে যে দিনটি ইংরেজি বর্ষপঞ্জির ১৪/১৫ এপ্রিল (ভারতে) এবং ১৪ এপ্রিল (বাংলাদেশে)। বাংলা সন সব সময়ই গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির চেয়ে ৫৯৩ বছর কম হয়। বাঙালী জাতি তথা বাঙালী মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্ববহ একটি দিন।

রাজদরবার চলছিলে সম্রাট আকবরের ফরমান মোতাবেক। ভালোই চলছিলো সবকিছু। সমস্যা ছিলো না কোনো। ছিলো না কোনো অভিযোগ। প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো কেবল রাজার খাজনা আদায়ের হিসাব সংরক্ষণের বিষয়টি।গড়মিল ছিলো হিসাব সংরক্ষণের সময় ও সংখ্যা নিয়ে। সংখ্যা মিলতো কিন্তু সময় মিলতো না। একেক জনের হিসাব সংরক্ষিত হতো একেক সময় হিসেবে। সম্রাট আকবর রাজজ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে নির্দেশ দিলেন, এই সমস্যার সমাধান চাই আমি। সুষ্ঠু সমাধান। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি মোতাবেক ৯৬৩ হিজরির ২৮ রবিউস সানি তারিখে সম্রাট জালালুদ্দিন আকবর শাহ সিংহাসনে আসিন হন। সম্রাটের এই ক্ষমতা গ্রহণের স্মৃতিকে চিরভাস্কর করে রাখার উদ্দেশ্যে রাজজ্যোতিষী ফতেহ উল্লাহ সিরাজী ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিলকে পহেলা তারিখ নির্ধারণ করে খাজনা আদায় এবং এর যাবতীয় হিসাব-নিকাশ সংরক্ষণের উপযোগী করে হিজরি ৯৬৩ সনের সাথে পরবর্তী সৌরমাস ও বছরের সংখ্যা যোগ করে নতুন একটি ফসলি সন প্রবর্তন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সন সৌরমাস হিসেবে গণনা হতো। পরর্বতীতে রাজজ্যোতিষী ফতেহ উল্লাহ প্রবর্তিত এই ফসলি সনই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের রুপান্তিত হয়। সুতরাং এই কথার মাঝে কোনো প্রকার কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বাংলা সনের সৃষ্টিতে হিজরি সনের অংশ গ্রহণগত ভূমিকাই মূল।

ইতিহাসও এই কথাই বলে, চলুন একটু দেখি উইকিপিডিয়াতে কি লেখা রয়েছে এই সম্পর্কে। ‘ভারতে ইসলামি শাসনামলে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরি পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরর চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। একারণে চান্দ্র বৎসরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। আর চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এজন্য ভারতের মোগল সম্রাট আকবারের সময়ে প্রচলিত হিজরি চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরি চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ওমর ফতুল্লাহ্ শিরাজির সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জীর অনুকরণে ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খৃস্টাব্দে সম্রাট আকবার হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ইতোপূর্বে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্চির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরি সালের মুহাররাম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।‘ [সূত্র : bn.wikipedia.org/wiki/বাংলা_সন]

এছাড়া বিখ্যাত ইতিহাসবিদ সৈয়দ আশরাফ আলী তার এক প্রবন্ধে এই বিষয়টিকে বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলা সনের প্রবর্তন যিনি করেন তিনি কোন বাংলাভাষী বা বাংলাদেশি নন। তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত চেঙ্গিস খান ও মহাবীর তৈমুর লং-এর সুযোগ্য বংশধর বিশ্ববিখ্যাত মোঘল সম্রাট আকবর দি গ্রেট। সুদূর দিল্লীতে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত থেকেই তিনি এ দেশে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। ‘সন’ ও ‘তারিখ’ দুটিই আরবি শব্দ। প্রথমটির অর্থ হল ‘বর্ষ’ বা ‘বর্ষপঞ্জী’ এবং অন্যটির অর্থ ‘দিন’। ‘তারিখ’ বলতে আবার ইতিহাসও বোঝায়।

‘সাল’ হচ্ছে একটি ফারসি শব্দ, যার অর্থ হল বৎসর। বাংলা সনের সূত্রপাত হয় আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ ইসলামি সনের ওপর ভিত্তি করেই একজন মুসলমান বাদশাহ কর্তৃক বাংলা সনের প্রবর্তন। স্বভাবতই, যারা ইতিহাসকে স্বীকার করেন না বা যারা ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ, তারাই মনে করেন যে, বাংলা সন অমুসলিমদের দ্বারা প্রবর্তিত একটি বর্ষপঞ্জী। ‘ইংরেজি’ তথা ‘গ্রেগরিয়ান’ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মক্কা থেকে মদীনায় ঐতিহাসিক হিজরত অবলম্বন করে প্রবর্তিত, এই হিজরি সন শুরু হয় ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬৫ জুলাই তারিখ থেকে। বাংলা সনের মূলে হিজরি সন বিদ্যমান বিধায় হিজরি সালকেই সুকৌশলে বাংলা সনে রূপান্তরিত করা হয়।

মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে তারই নির্দেশে ৯৯৮ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। বাদশাহ আকবর ৯৬৩ হিজরিতে অথাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে (১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে) দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনা চিরন্তরণীয় করে রাখার জন্য ৯৬৩ হিজরি অবলম্বন করেই বাংলা সন চালু করা হয়। অর্থাৎ ১, ২, ৩-এভাবে হিসেব না করে মূল হিজরি সনের চলতি বছর থেকেই বাংলা সনের গণনা শুরু হয়। ফলে জন্ম বছরেই বাংলা সন ৯৬৩ বৎসর বয়স নিয়ে যাত্রা শুরু করে। উল্লেখ্য, হিজরি সনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। মহানবি (সা.) স্বয়ং আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরি সন চালু করেননি। এটি প্রবর্তন করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে।

হিজরি সনের ক্ষেত্রে যে রকম হিজরতের দিন ও মাস (১২ রবিউল আউয়াল) সুনির্দিষ্টভাবে অবলম্বন না করে শুধুমাত্র সালটিকেই (৬২২ খ্রিস্টাব্দে) সংরক্ষণ করা হয়, বাংলা সনের ক্ষেত্রেও তেমনি সম্রাট আকবরের রাজ্যভিষেকের দিন ও মাস (১৪ইং ফেব্রুয়ারি) অবলম্বন না করে শুধুমাত্র বৎসরটি (৯৬৩ হিজরি) সংরক্ষিত হয়। হিজরি সনের প্রথমদিন হল পহেলা মহররম। বাংলা সনে তা পরিবর্তন করে পহেলা বৈশাখ করা হয়। ৯৬৩ হিজরিতে মহররম মাস ও বৈশাখ মাস একই সঙ্গে আসে। ফলে, তদানীন্তন শকাব্দের প্রথম মাসটি গ্রহণ না করে হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের অর্থাৎ বৈশাখ মাসকেই বাংলা সনের মাস হিসাবে পরিচিহ্নিত করা হয়। বাংলা সনের সৃষ্টি হয় ফসল তোলার সময় লক্ষ্য করে।

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সৌর বৎসর অবলম্বনে এই নতুন সন গণনা শুরু হয়। তাই, প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ‘ফসলী সন’ নামে অভিহিত হতো। ‘বাংলা’র জন্য উদ্ভাবিত বলে এটি পরবর্তী পর্যায়ে ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিহ্নিত হয়। উল্লেখ্য, একইভাবে ভারতের উড়িষ্যা ও মহারাষ্ট্র প্রদেশে যথাক্রমে ‘বিলায়তী’ ও ‘সুরসান’ নামে আঞ্চলিক সনের সৃষ্টি হয়। এসব সনেরও উৎস-সন হিসেবে হিজরি সনকেই গ্রহণ করা হয়।‘

মাওলানা মিরাজ রহমান
[email protected]



মন্তব্য চালু নেই