“বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ”

সাফাত জামিল শুভ : বাংলাদেশের জীবনস্পর্শী প্রতিবাদী সাহিত্য ধারায় এবং চলচ্চিত্র জগতে জহির রায়হান এক বিশিষ্ট শিল্পী। বলা যায়, এদেশের প্রগতিশীল চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন তিনি। চলচ্চিত্র প্রতিভার পরবর্তী আশ্রয়স্থল হলেও তার আবির্ভাব ঘটেছিল কথাসাহিত্যে। সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক, রাজনৈতিক কর্মী, চিত্রপরিচালক- নানা পরিচয়ে তার কর্মক্ষেত্রের পরিধি স্পষ্ট। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহন করেছেন। সংস্কৃতি ও রাজনীতি অঙ্গনের এই কৃতি পুরুষের মূল পরিচয় সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার হিসাবে। এছাড়াও তিনি – চলচ্চিত্র প্রযোজক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক, চিত্র সম্পাদক, চলচ্চিত্র সংগঠক। পুরোপুরি রাজনৈতিক আদর্শে বিপ্লবে বিশ্বাসী একজন মানুষ। সর্বোপরি তিনি একজন প্রতিবাদী মানুষ; যিনি ঐতিহ্যকে লালন করেছিলেন নিজের বিশ্বাসে বলিয়ান থেকে।

বলা হয়ে থাকে, এদেশের চলচ্চিত্রের তিনিই প্রথম সফল নির্মাতা। অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের সহযোগিতায় জহির রায়হান ছাত্রাবস্থায় বাম রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫৩ -১৯৫৪ সালের দিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা মনি সিংহের দেয়া রাজনৈতিক নাম ’রায়হান’ গ্রহণ করেন।

প্রতিবাদী সাহিত্য চর্চা করতে করেতই একসময় চলচ্চিত্রকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন প্রয়াত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। ছাত্রজীবন থেকেই ছায়াছবি সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। ছাত্রজীবনের শুরুতে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বই এবং পত্রপত্রিকার সঙ্গে তার পরিচয় ছিলো। পরবর্তীতে চলচ্চিত্রই তার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মাটিতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন বিলাস বহুল হোটেলে আমোদ-ফূর্তিময় জীবন যাপন, রাজনৈতিক ভাবে প্রতিপক্ষ আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসহীন বাঙালীদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র- প্রভৃতির প্রামাণ্য দলিল জহির রায়হান সংগ্রহ করতে থাকেন। দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত অধিকার হতে বঞ্চিত হওয়া, যুদ্ধের কৃতিত্ব পুরোটই ভারতের অধিকারে চলে যাওয়া, ভারতীয় বাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতা, এবং বেশ কয়েকদিন ভারতীয় বাহিনীর শাসন চলা প্রভৃতি ঘটনাবলী জহির রায়হানকে বেশ ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাছাড়া আদর্শস্থানীয় বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার দেশ স্বাধীন হবার ঠিক পূর্বে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তাকে বিচলিত করে তোলে।

অসম্ভব প্রানশক্তির অনধিকারী এই মানুষটি লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর মুলত পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে চলচিত্র শিল্পের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। নিঁপুন দক্ষতার সহিত চলচিত্র নির্মাণ শিল্পেও তিনি খুব অল্পসময়ে নিজেকে বিকশিত করেন। তার নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামান্য চিত্রগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে বিশ্বমানবতার টনক নাড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনী’র বর্বর অত্যাচার নিয়ে তার নির্মিত প্রামান্য চিত্রগুলো হচ্ছেঃ

* “Stop Genocide”, (১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধি কালীন সময়ে পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতার প্রামান্য চিত্র)
* “Birth of A Nation”
* “Liberation Fighters”(Production)
* “Innocent Milions”(Production)

এছাড়াও জহির রায়হান নির্মিত সফল বানিজ্যিক ছবিগুলোতে তার জীবন স্বমন্ধে গভীর ধারনার স্পষ্ট প্রমান হয়ে মেলে। অধিকাংশ চলচিত্রেই তিনি বাঙালীকে মুক্তির আশা দেখিয়েছেন। জহির রায়হানের নির্মিত চলচিত্রগুলো হলোঃ কখনো আসেনি, সোনার কাজল, কাঁচের দেয়াল(১৯৬৩), সংগ্রাম (১৯৬৪ ততকালীন পাকিস্তানের সর্বপ্রথম রঙিন চলচিত্র) , বাহানা (১৯৬৫), বেহুলা (১৯৬৬), আনোয়ারা (১৯৬৬), দুইভাই (১৯৬৮), জীবন থেকে নেয়া (১৯৬৯) ও ইংরেজী ভাষায় Let There Be Light।

জহির রায়হানের রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁর বিভিন্ন লেখা ও ছবিতে বিধৃত হয়েছে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে নির্মিত তাঁর কালজয়ী ছবি জীবন থেকে নেয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভিত নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষিত হওয়ার এক বছর আগে জহির রায়হান এই গানটি ব্যবহার করেছেন জীবন থেকে নেয়া ছবিতে, যার চিত্রায়ণও ছিল অনবদ্য। সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রনির্মাতারা জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়ার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিকতা ও চলচিত্র সাংবাদিকতার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ১৯৫০ সালে “যুগের আলো” পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন ও পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। উল্লেখ্য ১৯৫৬ সালে প্রবাহ পত্রিকায় জহির রায়হান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এমন আরেকটি কাজ করেছেন যা সচরাচর দেখা যায় না- তিনি গঠন করেছিলেন ‘সিনে ওয়ার্কশপ’ এবং সেই ওয়ার্কশপ থেকে তার তত্ত্বাবধানে তরুণ নির্মাতারা যৌথভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন। পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গীন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ ও প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ও তিনি নির্মাণ করেছিলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশি-বিদেশি নির্মাতারা বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। তবে দেশি নির্মাতাদের উল্লেখযোগ্য চারটি চলচ্চিত্রেই তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি নিজে নির্মাণ করেছেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ এবং ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’। আর প্রযোজনা করেছেন আলমগীর কবিরের ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ এবং বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’।ভাষা আন্দোলনের পটভুমিতে জহির রায়হানের লেখা “একুশে ফেব্রুয়ারী” ও “আরেক ফাল্গুন” নামক উপন্যাস দুটি তার অনবদ্য রচনা। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছেঃ সূর্যগ্রহণ, শেষ বিলেকের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আর কতদিন, কয়েকটি মৃত্যু, বরফ গলা নদী, তৃষ্ণা প্রভৃতি।নিঁপুন দক্ষতার সহিত চলচিত্র নির্মাণ শিল্পেও তিনি খুব অল্পসময়ে নিজেকে বিকশিত করেন। তার নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামান্য চিত্রগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে বিশ্বমানবতার টনক নাড়িয়ে দেয়।

১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।তাঁর স্কুল জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও পরের বছর অর্থনীতি ছেড়ে বাংলায় ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। যদিও পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে চলচ্চিত্রের প্রতি বেশি ঝোঁক ছিলো জহির রায়হানের। এ সময়ই সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয়।১৯৫৬ সালের শেষদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত বিখ্যাত চিত্রপরিচালক এ. জে. কারদার (আখতার জং কারদার) তখন পূর্ব পাকিস্তানের পটভূমিকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের উর্দু সংস্করণ জাগো হুয়া সাভেরা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন।মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রে জহির রায়হান সহকারী পরিচালক ছিলেন।

তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু’বার বিয়ে করেন: ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় আসেন জহির রায়হান। তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মীরপুরে যান । কিন্তু সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি।ধারণা করা হয়, স্বাধীনতার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানী আর্মির দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন তিনি।



মন্তব্য চালু নেই