বাংলার পাহাড়ে দশরথ মাঝির গল্প! অপেক্ষার শেষ, এবার গ্রামে আসবে পানি

পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়েছিলেন দশরথ মাঝি। যা নিয়ে ছবিও তৈরি হয়েছে বলিউডে। ভূটান সীমান্ত লাগোয়া বাংলার কয়েকজন যুবক গ্রামে পানীয় জল পৌঁছে দিতে যা করলেন, তাতে দানা মাঝির কথা মনে পড়তেই পারে।

একদিকে দুর্গম পাহাড়ি পথ, সামান্য ভুলচুক হলেই নিশ্চিত মৃত্যু। তার সঙ্গে যে কোনও মুহূর্তে লেপার্ড, অজগর, ভালুকের সামনে পড়ার আশঙ্কা। এমন বিপদশঙ্কুল পরিবেশে কাজ করবেন না বলে হাত তুলে নিয়েছিলেন সরকারি ঠিকাদার এবং তাঁদের কর্মীরা। শেষ পর্যন্ত কিন্তু ভূটান-লাগোয়া পাহাড়ি গ্রামগুলিতে জল পৌঁছল। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন পাহাড়ি ওই গ্রামগুলিরই ১৫জন যুবক।

আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনি ব্লকের রাজাভাতখাওয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বক্সাদুয়ার। সেখান থেকে কয়েক হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত আদমা, ফুলবাড়ি, সেওগাঁওয়ের মতো বিভিন্ন গ্রাম। বক্সাদুয়ায়েরর এই গ্রামগুলিতে পানীয় জল পরিষেবা বাড়ি বাড়ি পৌছে দেওয়ার দাবি দীর্ঘদিনের বলে জানান বক্সা অভিযান মঞ্চের সম্পাদক বিকাশ থাপা। দুর্গম এই গ্রামগুলিতে পানীয় জলের সংযোগ পৌঁছনোর সমীক্ষা করতে গিয়ে সরকারি আধিকারিকরাও পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যান। ঠিক হয়, ভূটান সীমান্ত লাগোয়া ঘোরেডাঙ্গা থেকে পাইপের সাহায্যে জল গ্রামগুলিতে নিয়ে আসা হবে। কারণ, ঘোরডাঙার ওই জায়গাতেই প্রাকৃতিকভাবে সারা বছর পানীয় জল পাওয়া যায়। কিন্তু প্রায় সাড়ে ছ’হাজার ফুট উচ্চতার দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ঘোরেডাঙ্গা থেকে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে জলের পাইপ বসানোর কাজ করতে রাজি হননি কেউই। ফলে যাবতীয় পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়।

শেষ পর্যন্ত স্থানীয় গ্রামের যুবকদেরই শরণাপন্ন হন সরকারি আধিকারিকরা। প্রকাশ থাপা নামে সদর বাজার এলাকার এক যুবকের নেতৃত্ব তৈরি হয় ‘ওয়াটার এক্সপিডিশন টিম’।

প্রকাশ জানান, গত ১৫ জানুয়ারি কয়েক কুইন্টাল ওজনের লোহার পাইপ, শক্তপোক্ত দড়ি, দা, ছুড়ি, পাইপ কাটার যন্ত্র, রুকস্যাক, তাঁবু, চাল, ডাল, কেরোসিনের উনুন, মশলা ও সামান্য সব্জি নিয়ে রওনা দেন তাঁরা। আট ঘণ্টা ট্রেকিং করে ঝান্ডিডারা, দাবগোলুংয়ের হয়ে ঘোরেডাঙ্গা পৌঁছন তাঁরা। অন্তত এক হাজার ফুট নীচে থাকা গ্রামগুলিতে জল পৌঁছে দেওয়ার জন্য এর পরেই শুরু হয় মরণপণ লড়াই।

প্রচণ্ড ঠান্ডা, পাহাড়ি চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শুরু হয় জলের পাইপ বসানোর কাজ। কাজ করতে করতে প্রকাশরা ভালুক এবং ব্ল্যাক প্যান্থারের দেখাও পেয়েছেন। এছাড়াও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে নানারকম বিষাক্ত পোকামাকড়, বিছে, জোঁকের উপদ্রব তো ছিলই। জলের উৎস পর্যন্ত পৌঁছতে দু’টি পাহাড়ের খাঁজ পারাপার করার জন্য মইও ছিল না। ফলে পাশাপাশি বাঁশ রেখে পাহাড়ি খাঁজ পেরিয়েছেন। যা চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়াও, বৃষ্টিতে মাঝেমধ্যেই আটকে থেকেছে কাজ। তবুও প্রকাশের দল হাল ছাড়েনি। টানা বাইশ দিন ধরে ঘোরেডাঙ্গার উৎসে পড়ে থেকে জলের সংযোগ তৈরি করার কাজ শেষ করেন তাঁরা। এর পরে গত প্রায় দু’মাস ধরে পাহাড়ি গ্রামগুলিতে পাইপলাইন পাতার কাজ চলেছে। বসেছে নতুন জলের কল।

এই অসম্ভবকে তাঁরা যে শেষপর্যন্ত সম্ভব করেছেন, হিন্টে ডুকপার মতো যুবকদের যেন তা বিশ্বাসই করতে পারছেন না। কারণ পরিবার, চেনা-পরিচিত সবাই তাঁদের এই বিপজ্জনক কাজে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু হিন্টেদের দাবি, এতগুলি গ্রামের মানুষদের পানীয় জলের সমস্যার কথা ভেবেই তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন।

বক্সা পাহাড়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কোঅর্ডিনেটর সুব্রত মজুমদার জানান, আগে বক্সা পাহাড়ে পুরানো জলের লাইন ছিল। কিন্তু সেটি অকেজো হয়ে যাওয়ায় পুরো পানীয় জলের পরিষেবাই দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ হয়েছিল। এবারের পানীয় জল প্রকল্প সফল হলে তা হবে নজিরবিহীন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের জলের মিস্ত্রি খগেন রায় জানান, ‘জীবনে অনেক সরকারি জল প্রকল্পের কাজ কাজ করেছি। কিন্তু এইভাবে পাহাড়ি যুবকদের সঙ্গে ট্রেকিং করে গিয়ে জলের লাইন বসানোর এই কাজ কোনওদিন ভুলব না। যে কোন সময়ে দড়ি ছিঁড়ে গেলে কেউ বেঁচে ফিরতাম না।’

প্রকল্পের খরচ প্রায় পনেরো থেকে কুড়ি শতাংশ বেড়েছে। কারণ, এক বস্তা সিমেন্টের দাম যদি ৩৫০-৪০০ টাকা হয়ে থাকে, সেই সিমেন্ট পিঠে করে চড়াই-উৎরাই বেয়ে উঁচু পাহাড়ি জায়গায় নিয়ে যেতে সমপরিমাণ খরচ হয়েছে।
জলের উৎস কোথায়, দেখুন ভিডিও

আদমা, ফুলবাড়ির মতো দু’-একটি গ্রামে জলের লাইনের সামান্য কিছু কাজ বাকি আছে। পরীক্ষামুলকভাবে ঘোরেডাঙ্গার পানীয় জল উৎসের থেকে নতুন পাইপলাইনের মাধ্যমে জল এনে সিমেন্ট বাঁধানো জলাধারে মজুত করা হচ্ছে। সেখান থেকেই তা গ্রামে বসানো নতুন কলের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। সব গ্রামে ঠিকমতো জল যাচ্ছে কি না, তা দেখে নেওয়া হচ্ছে।
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তরের কার্যনির্বাহী বাস্তুকার তিমির বসু জানিয়েছেন, এই মাসের শেষের দিকেই প্রায় কুড়ি হাজার মানুষকে কলের মাধ্যমে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।



মন্তব্য চালু নেই