বাংলাদেশ ভ্রমণে ‘বাঙাল’দের চেয়ে ‘ঘটি’রা এগিয়ে

বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ‘বাঙাল’দের চেয়ে ‘ঘটি’রাই এগিয়ে। গত বছরের পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ভিটেমাটির টান বা শেকড়ের সন্ধানে নয়, নিছক ভ্রমণের জন্যই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বাংলাদেশে যাওয়ার প্রবণতা উত্তরোত্তর বাড়ছে। বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির, চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল, রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ, কক্সবাজারের দীর্ঘ অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত, কুষ্টিয়ার লালন ফকিরের মাজার ও ঢাকার মোরগ পোলাও কিংবা ইলিশের স্বাদের টানে তারা ছুটছেন।
বাংলাদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রকমারি খাদ্যের সম্ভারই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ওপার বাংলায় টানছে বলে মনে করছেন পর্যটন সংস্থা ও ট্যুর অপারেটিং সংস্থার কর্মকর্তারা। তাদের মতে, বাঙালদের চেয়ে ঘটি পর্যটকরাই বাংলাদেশে যাচ্ছে বেশি। এটা সে দেশের পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে বড় সাফল্য এবং এটা নতুন ধারার সূচনা করছে।
বাংলাদেশ সরকারের ট্যুরিজম বোর্ড চলতি বছরকে ‘ভিজিট বাংলাদেশ ইয়ার’ বলে ঘোষণা করেছে। আর তার আগেই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায় বিষয়টিকে অন্য মাত্রা দেবে বলে আশাবাদী এই রাজ্যের পর্যটন সংস্থাগুলো।

কলকাতার ‘দেশ দুনিয়া ট্যুর’ গত দেড় যুগ ধরে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের পর্যটকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে বড় ভূমিকা নিচ্ছে। তাদের কর্ণধার তথা ‘ইনবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস কাউন্সিল’- এর সভাপতি শুদ্ধব্রত দেব বলেন, ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের যত বাঙালি বাংলাদেশ ভ্রমণে গেছেন, তাদের ৭০ শতাংশেরই বাংলাদেশে কোনও শেকড় নেই। তারা পশ্চিমবঙ্গের খাঁটি বাঙালি। তার মানে বাংলাদেশে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি দেখা-টেখা নয়, তারা বাংলাদেশে যাচ্ছেন নিছক ভ্রমণের জন্য।

বাংলাদেশে ভ্রমণে নিয়ে যায়, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের এমন বহু পর্যটন সংস্থার কর্মকর্তাদের বিশ্লেষণ, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা ২০১৭ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নেপাল ও ভুটানে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা ছাপিয়ে যাবে। এখন মোটামুটি বছরে এক লাখ পর্যটক ভারত থেকে বাংলাদেশে যাচ্ছেন। এই সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

আমার শেকড় খুলনা জেলার বটবুনিয়া গ্রামে। দেশভাগের কিছু আগেই বাবার চাকরিসূত্রে ওপার বাংলার পাট চুকিয়ে পাকাপাকি কলকাতায় পাড়ি দেওয়া। পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতার সূত্রে, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি আমন্ত্রণে, বন্ধুদের বাড়িতে ও তাদের সামাজিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে অসংখ্য বার বাংলাদেশে গিয়েছি। শুধু রাজধানী ঢাকা বা নিজের জেলা খুলনা নয়, যশোর, ময়মনসিংহ, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ প্রায় গোটা বাংলাদেশ ঘোরার সুযোগ হয়েছে। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ক্রীড়া পর্ষদের প্রতিনিধি হিসেবে, তাদের পাঠানো অল্পবয়সীদের একটি ফুটবল দলের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় যেতে পেরেছিলাম। তখনই মনে হয়েছিল, ঘরের কাছে এমন সুন্দর বিদেশ ছেড়ে আমরা পয়সা খরচ করে কেন দূর দেশে যাই! তখন থেকেই কিন্তু বাংলাদেশ ক্রমশ নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছিল। এখন সেটা পরিণতি পেয়েছে দেখে ভালো লাগছে।

একটা সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালদের অর্থাৎ যাদের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশে, তাদের সেখানে বেড়াতে যাওয়ার অন্যতম কারণই ছিল, নিজেদের শেকড় একবার দেখে আসা। পর্যটন শিল্প মহলের পরিভাষায়, যাকে বলে ‘ডাউন মেমরি লেন ট্যুর’। সপরিবার কোনও পর্যটক ঢাকার বিক্রমপুরের একটি গ্রামে গিয়ে নিজের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি দেখলেন এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশটাও ঘুরে নিলেন।

পর্যটন সংস্থাগুলো বলছে, পশ্চিমবঙ্গের এই ধরনের পর্যটকদের সংখ্যাই ২০১০ পর্যন্ত বেশি ছিল। কিন্তু তার পর থেকে বদল আসতে শুরু করে। এখন ওদেশে শেকড় নেই, এমন পর্যটকেরাও বেড়াতে যাচ্ছেন। আর তাদের সংখ্যাই অনেক বেশি। অর্থাৎ তাদের কাছে বাংলাদেশ নিছক একটি পর্যটনস্থল হিসেবেই গুরুত্ব পেয়েছে।

পর্যটন সংস্থাগুলোর মতে, এর একটা কারণ অবশ্যই বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা। আর সেই সঙ্গে পর্যটনের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরিতে অনেকটাই এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। যাতে পশ্চিমবঙ্গের এখনও বহু কমতি আছে বলে পর্যটন বিশেষজ্ঞদের অভিমত। অথচ বাংলাদেশে রাস্তা ঠিকঠাক হয়েছে, ভালো হোটেল রয়েছে, বিলাসবহুল ক্রুজে ভ্রমণ করা যাচ্ছে এবং কলকাতা-ঢাকা শুধু নয়, কলকাতা-চট্টগ্রাম সরাসরি বিমান চালু হওয়ায় পর্যটকদের উৎসাহ ও সুবিধা বেড়েছে বহুগুণ। আবার এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিমান পরিষেবার ক্ষেত্রে নামী সংস্থা নোভো এয়ার কলকাতা-ঢাকা সরাসরি ফ্লাইট চালু করছে বলে জানা গেছে। পর্যটকদের চাহিদা আছে বলেই বিমান বাংলাদেশ, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ, এয়ার ইন্ডিয়া, জেট এয়ারওয়েজ, ইউনাইটেড এয়ারের পাশাপাশি আরও একটি এয়ারলাইন্স আসছে।

পশ্চিমবঙ্গবাসীর জন্য বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে কলকাতা-ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাঙামাটি-কক্সবাজার এবং কলকাতা-খুলনা-বরিশাল-সুন্দরবন‌-ঢাকা এই দু’টি প্যাকেজ জনপ্রিয়। সড়কপথ, ক্রুজ, বিমান এবং হোটেলভেদে খরচের হেরফের হয়। তবে ট্যুর অপারেটরদের হিসাবে, ভারতীয় মুদ্রায় সর্বনিম্ন মাথাপিছু ১৫ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে বাংলাদেশ ভ্রমণ করা যায়।

বাংলাদেশের আকর্ষণ কিন্তু অন্য জায়গায়। ১৯৭৪ সালে ভারত-বাংলাদেশ কাবাডি টেস্ট কভার করতে গিয়েই সেটা টের পেয়েছিলাম। আর তার ৪১ বছর পর, ২০১৫ সালের অক্টোবরে সপরিবারে বাংলাদেশ বেড়াতে যাওয়া একটি বহুজাতিক সংস্থার কর্মকর্তা, দক্ষিণ কলকাতার কসবা এলাকার বাসিন্দা অরুণাভ মৈত্রের কথা শুনে বুঝলাম, সেই আকর্ষণ একইরকম আছে এখনও। চীন, ইউরোপ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ঘোরা অরুণাভ, তার সাংবাদিক স্ত্রী ও স্কুলপড়ুয়া কন্যা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে গিয়ে মুগ্ধ। ফের যেতে চান। ওরা কিন্তু বাঙাল নন, বরং খাঁটি ঘটি, মানে বাংলাদেশে কোনও শেকড় নেই। বাংলাদেশের সবচেয়ে কী ভালো লাগল? এমন প্রশ্নে অরুণাভ বললেন, ওখানকার মানুষ। মানুষের ব্যবহার, তাদের আন্তরিকতা। পর্যটক টানতে ওটাই বাংলাদেশের আসল ইউএসপি (Unique selling proposition)।



মন্তব্য চালু নেই