বাংলাদেশ অধিনায়কের সংসারের বাঙ্গালিয়ানা

পাঁচতলার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়ালে চমকাতে হবেই, ১০ থেকে ১ নম্বর, নানা সাইজের অসংখ্য স্যান্ডেল আর জুতা। মনে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য, ১৩৫০ বর্গফুটের এ বাড়িতে আসলে কজন থাকেন? প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের অবস্থানকালে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেছে। ভাই, বন্ধু আর শ্যালক মিলিয়ে বারো থেকে জনা পনেরোকে ঘিরে মাশরাফি বিন মর্তুজার সংসার। দরজা খুলতেই ড্রয়িংরুমের সোফায় তিন কন্যার একজন বাংলাদেশ অধিনায়কের, বাকি দুজন ফোকলা দাঁতের হাসিতে জানাল, ‘মাশরাফি আমার মামা’, আর অন্যজনের চাচা। বিভিন্ন বয়সী নারীর সাবলীল উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, তাঁরা অনাহূত নন, এ পরিবারে তাঁদের অধিকারও মিসেস মাশরাফির চেয়ে কম নয়।

একসময় মিসেস মাশরাফি, মানে সুমিও বাইরে থেকে ফিরলেন। হাতে একগাদা ব্যাগ, বুঝতে অসুবিধা হয়নি শপিংয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁকে ফিরতে দেখেই বাচ্চাদের হুল্লোড়। বছর চারের সুমাইয়ার চিৎকার, ‘মা, কি আনছো?’ সঙ্গে ওর কাজিনদেরও আবদার ‘মামি’ কিংবা ‘চাচি’র কাছে, ‘ব্যাগে কী আছে?’ সেও দেখা হলো মিনিটখানেকের মধ্যেই। একই রং আর ডিজাইনের লেহেঙ্গা পরে তিন শিশুর সে কী আনন্দ! বিলীন প্রায় একান্নবর্তী সংসারের ছবিটা তো এমনই, সবাই মিলে একরকম পোশাকে আনন্দে মেতে ওঠা। ঢাকার একটি ১৩৫০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের এ অনাবিল আনন্দধারা ২০১৫ সালে দেখতে পাওয়াটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার। যে যুগে সংসার টুকরো হতে হতে আত্মীয়তার বন্ধন বিচ্ছিন্ন প্রায়, সেখানে একজন মাশরাফির সংসারে রীতিমতো আত্মীয়-পরিজনের হুল্লোড়, যেখানে মাশরাফির সন্তানরা কাজিনদের সঙ্গে একই পোশাকে আনন্দে মেতে ওঠে, একই পাতে খাবার খায়। আমরা দূরের অনাহূতরা হুট করে বাড়িতে ঢুকে যে দৃশ্য দেখে চমকে যাই, বিমোহিত হই আবার আবেগে আক্রান্তও হই।

মাশরাফি বিন মর্তুজা হাসেন, ‘কিরে কইথ্যে আইলি?’ ততক্ষণে ওই সংসারে এন্ট্রি হয়েছে রক্তের সম্পর্কহীন আরেকজনের। হাতে বাজারের ব্যাগ, ফাঁক গলে উঁকিঝুকি দিচ্ছে আনাজ। ‘বাজার থাইকে ফিরলাম’, উত্তরদাতা মাশরাফির বন্ধু, আসলে ছায়াসঙ্গী বলাই ভালো। শুধু খেলার মাঠ আর ড্রেসিংরুমেই প্রবেশাধিকার নেই তাঁর, আর সবখানেই মাশরাফির সঙ্গী তিনি। বিশেষ অনুরোধে সেই বন্ধুটির নাম গোপনই রাখতে হলো। ‘এরাই আমার প্রাণ, আমার জন্য জীবন দিতেও দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে না’, বলার সময় কৃতজ্ঞতায় মাশরাফির গলা কেঁপে ওঠে। যা শুনে আমরা আপ্লুত হই, ‘এই না হলে বন্ধু!’ বন্ধু, পাড়া-প্রতিবেশীদের জন্য মাশরাফি অনেক কিছুই করেন বলে শুনেছি। তবে এ বন্ধুতা স্রেফ দেওয়া-নেওয়ার বৃত্তবন্দি নয় মোটেও। ২০১১ বিশ্বকাপ দল থেকে মাশরাফির বাদ পড়ার পর তাঁর বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া দেখেছি। বিস্মিত, বিমূঢ়, ক্ষুব্ধ বন্ধুদের সে দলটি সারাক্ষণই ছায়ার মতো ঘিরে রাখত তখন মাশরাফিকে। এত দিন পরও, খেলার ফাঁকে মাশরাফি ফিরলেই সেসব বন্ধুরা ভিড় করেন মিরপুরের এ ফ্ল্যাটটিতে। আত্মীয়দের মতো তাঁদের আনাগোনায়ও সম-অধিকারের ছাপ। সময়-অসময় নেই। ব্যক্তিগত জীবনের বেলায় এসব বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? হতে পারে, তবে যাঁর জীবন, সেই মাশরাফি কিন্তু এতেই স্বচ্ছন্দ। আর পরিবারটা তো তাঁরই, ‘চারপাশে মানুষ না থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে!’ বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ কারণেই বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাশরাফি বিন মর্তুজা। সবাইকে একই পোশাকে, একই খাবারে ভাগ দেওয়ার মানসিকতাই সর্বজনপ্রিয় করে তুলেছে তাঁকে।

দুপুর একটায়ও মাশরাফির চোখে ঘুম। টানা তিন ওয়ানডের ধকলে শরীরটা যে ঠিকঠাক নিতে পারছে না আর, তা দৃশ্যমান। ‘এখানে ব্যথা, ওখানে মনে হচ্ছে ছিঁড়ে যাচ্ছে ভাই। ছয়টার দিকে ঘুমাইছি’, নিজেই বলছিলেন মাশরাফি। ওই ক্লান্ত শরীরে কোলে তুলে নিলেন পেজা তুলোর মতো তুলতুলে আট মাসের জুনিয়র মাশরাফিকে, ‘পোলা আমারে চিনেই না ঠিকমতো। দেখে না তো!’ জুনিয়র মাশরাফি সাহিল সত্যি সত্যিই বাবার কোলে বসে আরো চেনা কারো খোঁজে ইতিউতি তাকাচ্ছে, হাত-পা ছুড়ছে। মেয়ে অবশ্য চিনে গেছে ভালোমতোই। বাবার হাত ধরে মাঠে যায়, বাবার খেলা দেখে ‘মাশরাফি’, ‘মাশরাফি’ বলে চেঁচায়ও! বাবা মাশরাফি কাছে টেনে নেন মেয়েকে, ‘ক্রিকেট খেলতাম আনন্দের জন্য, এখন এটাকে আরো বেশি ভালোবাসি পেশা হিসেবে। ছেলেমেয়ে দুটা বড় হচ্ছে না!’ সন্তানরা বড় হচ্ছে আর চিন্তা বাড়ছে মাশরাফির, ‘দোয়া করবেন ওরা যেন জীবনে ভালো মানুষ হয়।’

ছেলেমেয়েদের কথার সূত্র ধরে মাশরাফি আর দশজন বাবার মতো প্রবল সংসারী। বিশ্বকাপের পর পর গোটা সাতেক এন্ডোর্সমেন্ট হয়েছে। সেই সুবাদে প্রাপ্ত অর্থ কোথায় বিনিয়োগ করলে সবচেয়ে লাভবান হবেন, সে চিন্তাও করেন। আবার পরক্ষণেই জীবনবোধ তাড়া দেয় তাঁকে, ‘ভালো মানুষ না হলে আর টাকাপয়সা দিয়ে কী হবে ভাই!’ অতি সামান্য চাওয়া, তবু যান্ত্রিক জীবনে কী অসম্ভব চাওয়া মনে হচ্ছে! মাঝে মিসেস মাশরাফি ঘুরে গেলেন, দেশের একজন শীর্ষ সেলিব্রিটির স্ত্রী, কিন্তু কি আন্তরিক জিজ্ঞাসা, ‘ভাই, বাসার সবাই ভালো তো? আপনি কি রোজা রেখেছেন?’ অতি সামান্য ভদ্রতা, কিন্তু ব্যস্ত নাগরিক জীবনে কি পরম সৌজন্যবোধ!

যাঁদের বিচরণ করতে দেখেছি কাল, তাঁরা সবাই কিন্তু এ ফ্ল্যাটের নিয়মিত বাসিন্দা নন। তবে সংখ্যাটা কখনোই কমে বলে মনে হয় না। নড়াইল থেকে বাবা-মা আসেন প্রায়ই, আসেন মাশরাফির অতি প্রিয় ছোট মামাও। আরো নিয়মিত একদল নড়াইলবাসী, যারা স্নেহের মাশরাফির জন্য নিয়ে আসেন দুধ-ডিম-মাছ। ঢাকার বাজার থেকে যে সামান্যই কেনাকাটা করেন মাশরাফি, ‘আমার বাসার প্রায় সব খাবারই নড়াইল থেকে আসে। চেষ্টা করি বাচ্চারা যেন স্বাস্থ্যকর খাবারটা খায়। পোশাক নিয়ে অত ভাবি না। একমাত্র ঈদ ছাড়া বাচ্চাদের জন্য দামি পোশাক কিনি না, কিন্তু খাওয়াটা হতে হবে মনের মতো।’

দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে বেলা গড়িয়ে যায়। অতি সামান্য গৃহস্থালি কথাবার্তা, কিন্তু কেন যেন অসামান্য। মনে হয় এ কারণেই বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের তিনি যোগ্য কর্তা। সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে গড়ে তোলা একটা দল, যে দলের সুখ-দুঃখের সাথী সবাই।



মন্তব্য চালু নেই