বাংলাদেশে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন : যুক্তরাজ্য

বাংলাদেশে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন। দেশটির জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকারসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা দুর্বল। দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রচুর অনিয়ম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, শারীরিক নির্যাতন এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। দেশটিতে ঘুষ এবং দুর্নীতির ব্যাপক চর্চা হয়। ঘুষ এবং দুর্নীতির কারণে সরকারি-বেসরকারি অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কাঙ্ক্ষিত ফল আসে না। রাজনীতিক, আমলা এবং আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সদস্যরা প্রায়ই তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি করেন।

যুক্তরাজ্য সরকারের ফরেন এবং কমনওয়েলথ কার্যালয় ‘বিদেশীদের বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে ঝুঁকি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন বুধবার প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।

মূলত যুক্তরাজ্যের যে সব ব্যবসায়ী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী এবং বিনিয়োগ করেছেন তাদের জন্য পরামর্শ দিয়ে দেশটি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

যুক্তরাজ্য সরকারের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি, মানবাধিকার, ঘুষ ও দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি, নিরাপত্তা সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচনগুলোতে সংঘটিত অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় নির্বাচন কমিশনের একটি চলমান প্রকল্প থেকে অন্য দাতা দেশগুলোর সঙ্গে চলতি জুলাই মাসে আর্থিক সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাজ্য। প্রকল্পটি হল ‘বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’। জাতিসংঘ বাংলাদেশ অফিসের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, ইলেক্ট্ররাল টেনিং ইনস্টিটিউট (ইটিআই), ন্যাশনাল আইডেনটিটি রেজিস্ট্রেশন ইউং (এনআইডি), ইউরোপীয় কমিশন, যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ডিএফআইডি এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ইউএসএইড ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করছে। চলতি জুলাইয়ের পর ওই প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যাবে বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে, যার মেয়াদ ছিল আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত।

‘বিদেশীদের বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে ঝুকি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্র এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ। দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। দল দুটির মধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক দুর্বল। দল দুটির মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান বিরাজমান এবং তাদের রাজনৈতিক ধারা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত।

জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকারসহ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা দুর্বল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে তার দল নিরঙ্কুশ ভোট নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে। অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি ওই নির্বাচনকে বয়কট করলে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। ওই সময়ের বিরোধী দল (বিএনপি) নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছিল। কিন্তু এর আগে ২০১১ সালের জুনে বিতর্কিতভাবে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথা বাতিল করা হয়। ফলে বিএনপি ওই নির্বাচনে বয়কট করায় বর্তমানে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের এপ্রিলে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিএনপি ওই নির্বাচনের মাঝপথ থেকে ফিরে আসে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, অর্থনীতির উন্নয়নে বাংলাদেশ দরিদ্রতার হার উল্লেখজনকভাবে কমাতে সক্ষম হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দরিদ্রতাকে বিদায় করতে চায় এবং মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে চায়। বৈদেশিক মুদ্রা দেশটির অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিচ্ছে।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রচুর ক্ষতি করেছে। চলতি বছরে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং আগামী বছরে ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করছেন দেশটির নীতিনির্ধারকরা, যেখানে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৫ থেকে ৬ শতাংশ।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে স্থান করে নিয়েছে। দেশটির রফতানিযোগ্য পণ্যের ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। আর দেশটির বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির ১২ শতাংশই এই খাতের। কিন্তু ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির কারণে তৈরি পোশাক খাতের উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি। ওই ঘটনায় এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক প্রাণ হারান। পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিনিয়োগকারীদের চাপ এবং সহায়তায় বাংলাদেশ শ্রম পরিবেশ এবং কারখানার অবকাঠামো ঝুঁকিমুক্ত করতে কাজ করেছে। কেননা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্যকর শ্রম পরিবেশ প্রয়োজন।

আইনের প্রয়োগ, ন্যায়বিচার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা সম্পর্কে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন (আইসিসিপিআর), অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আইন (আইসিইএসসিআর), শিশু অধিকারসহ (সিআরসি) বাংলাদেশ মৌলিক আন্তর্জাতিক আইনগুলোর সংস্কার করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সঠিক আইনের প্রয়োগ এবং চর্চা দুর্বল।

বাংলাদেশে ন্যায়বিচার পাওয়া খুবই কঠিন। বাংলাদেশে আইনের প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন দুর্বল। বিচারিক আদালতে অনেক বছর আগের প্রচুর মামলার জট পেকে আছে। বাংলাদেশের আইনে এখনো শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর। দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রচুর অনিয়ম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, শারীরিক নির্যাতন এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের ঘুষ এবং দুর্নীতির চর্চা নিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ঘুষ এবং দুর্নীতির ব্যাপক চর্চা হয়। ঘুষ এবং দুর্নীতির কারণে সরকারি-বেসরকারি অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেরই কাঙ্ক্ষিত ফল আসে না। রাজনীতিক, আমলা এবং আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সদস্যসরা প্রায়ই তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি করেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির তালিকায় ২০১৪ সালে বিশ্বের ১৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৫, যা ২০১৩ সালে ১৩৬, ২০১২ সালে ১৪৪ এবং ২০১১ সালে ১২০-এ অবস্থান ছিল। বিশ্বব্যাংকের ২০১৫ সালের জরিপ করা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের তালিকায় বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৩ নম্বরে, যা আগের বছর ছিল ১৩০ নম্বরে।



মন্তব্য চালু নেই