“বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করে না ১৫ কোটি মানুষ”

বিটিআরসির হিসেবে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারির সংখ্যা ৬ কোটি ১২ লাখ ৮৮ হাজার। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে দেশে প্রায় ১৪ কোটি ৮০ লাখ লোক ইন্টারনেট সুবিধা পান না। ইন্টারনেট সুবিধাবঞ্চিত জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এ বিপুলসংখ্যক মানুষকে ‘অফলাইন’ জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহিত করা হয়েছে বলে দাবি করছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন কলের দাম কম। কিন্তু ইন্টারনেট ব্যয় অনেক বেশি। আইসিটিখাতে ০.৫ শতাংশ কর্মসংস্থান রয়েছে। সোমবার তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের উপস্থিতিতে ঢাকার একটি হোটেলে ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৬: ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্টারনেট ব্যবহার সুবিধায় সবচেয়ে বঞ্চিত ভারতের জনগণ। সে দেশে ১০৬ কোটি লোকের ইন্টারনেট সুবিধা নেই। বাংলাদেশের ওপরে আরও আছে চীন, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান। তবে প্রতিবেদনে সারা বিশ্বে এক দশকের ব্যবধানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তিন গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টিও উঠে এসেছে। সংস্থাটির হিসাবে, বিশ্বে বর্তমানে ৩২০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। প্রতিবেদন তৈরিতে সর্বশেষ ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়ের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটি। কিন্তু তাদের সিংহভাগের ইন্টারনেট সুবিধা নেই। এতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে যে কর্মসংস্থান হয়, তা বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের আধা শতাংশেরও কম। বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও সরকারি সেবা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা আরও বাড়াতে হবে।

প্রতিবেদন প্রকাশের পর ‘বাংলাদেশে ডিজিটাল বিবর্তন’ শীর্ষক একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদের সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কার্যক্রমে ই-সেবা বিভাগের প্রধান আবদুল মান্নান, বেসরকারি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের সহকারী অধ্যাপক খান মো. আনোয়ারুস সালাম প্রমুখ। প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিব টি আই এম নুরুল কবীর বলেন, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি–সম্পর্কিত বিদ্যমান নীতিমালাগুলো এই খাতের এগোনোর জন্য সহায়ক নয়। উচ্চ কর হার এই খাতের বিকাশ ও নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণে অন্যতম বাধা।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ইন্টারনেট ব্যবহারকারির সংখ্যার বিষয়টি এরিয়ে যান। তবে এ সময় তিনি বলেন, দেশের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে শিগগিরই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) অনুমোদন দেয়া হবে। এই আইনের খসড়া অনুমোদনের জন্য শিগগিরই মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। ডিজিটাল ডিভাইস বা প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ব্যবহার করে সংঘটিত যেকোনো ধরনের নেতিবাচক কার্যক্রম আইনের আওতায় আনতে সরকার এ আইন করছে। পলক বলেন, একটা সময় শুধু পোশাক রপ্তানি নিয়ে স্বপ্ন দেখতো বাংলাদেশ। এখন আইসিটি রপ্তানিতেও আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। শিগগিরই রপ্তানিতে পোশাক শিল্পের পরই আইসিটির অবস্থান থাকবে। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা ৫ বিলিয়ন সমপরিমাণ অর্থ রপ্তানি আয় করতে চাই; যা হবে মোট জিডিপির ৫ শতাংশ। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশে এখন ৭ হাজার ইন্টারনেট বেইজড কর্মসংস্থান রয়েছে। মানব সম্পদ উন্নয়নের স্বার্থে আমরা একে ২৫ হাজারে উন্নীত করতে চাই। এজন্য যুব সমাজকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। সেজন্য প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, আইসিটিখাতে দক্ষ জনবল তৈরি করা হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েক হাজার মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আইসিটিখাতের আওতা বাড়ানোর জন্য গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাইটেকপার্ক স্থাপন করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নির্ধারণে বিটিআরসির নিয়ম হলো, ৯০ দিন বা তিন মাসের মধ্যে একজন ব্যক্তি একবার ব্যবহার করলেই তিনি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। কিন্তু সরকার ও বিশ্বব্যাংকের হিসাবের পার্থক্য কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে এ প্রতিবেদনের সহপরিচালক দীপক মিশ্র জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক বৈশ্বিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা গণনা করে থাকে। হিসাবের পার্থক্যের কারণ তিনটি। প্রথমত, এটি ২০১৪ সালের আগস্ট মাসের হিসাব; দ্বিতীয়ত তথ্য উৎস এবং তৃতীয়ত, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংজ্ঞা। বিশ্বব্যাংকের কাছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংজ্ঞা হলো, একজন ব্যবহারকারীকে নিয়মিতভাবে তা ব্যবহার করতে হবে। অফিসের পাশাপাশি নিজের বাসায় ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা থাকতে হবে।

এদিকে বিবিসি বাংলা “ইন্টারনেট সংযোগে কেন পিছিয়ে বাংলাদেশ?” শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে। সেখানে বিশ্বব্যাংকের রেফারেন্স দিয়ে লিখেছে, এই খাতে যত কাজ তৈরি হওয়া সম্ভব তাও বাংলাদেশে ততটা হচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাপক প্রসার হয়েছে মোবাইল ফোন ব্যাবহারে। বিশ্বে যে দেশগুলোর মোবাইল কল খরচ খুব সস্তা, এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুযায়ী দেশের মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সিংহভাগই আসেন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। কিন্তু ব্রডব্যান্ড বা ওয়াইম্যাক্স সংযোগের ক্ষেত্রে খরচ এখনও অনেক বেশি। বাংলাদেশের টেলিকম বিশেষজ্ঞ আবু সায়িদ খানের কাছে বিবিসি এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এই পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে মূলত দুটি বাধা কাজ করে। গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বেশি এবং ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরিতে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করা—এই দুই কারণেই ইন্টারনেট সংযোগে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। তিনি আরও বলেন, মূল সেবা প্রদানকারীর কাছে থেকে গ্রাহকের কাছ পর্যন্ত ইন্টারনেটের সংযোগ পৌছতে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের হস্তক্ষেপে দাম বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে এটি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে।



মন্তব্য চালু নেই