বর্তমান আন্দোলনের ভবিষ্যৎ

বয়সের কারণে হোক বা বাস্তবতা উপলব্ধির করে হোক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুুল মুহিত প্রায়ই সত্য উচ্চারণ করেন। এসব সত্য কথা ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ যে প্রচার প্রপাগান্ডা চলছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। শেয়ারবাজার লুটপাটের পর তিনি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন আমিই সম্ভবত এখন দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই নির্বাচনে সত্যিকার অর্থে আমরা ম্যান্ডেট পাইনি। আরেকটি নির্বাচন আমাদের করতে হবে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধী দলের চলমান অবরোধ ও হরতালে রাজধানীর বাইরের অবস্থা ভয়াবহ।

অর্থাৎ সারা দেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন যে সফল হচ্ছে তা তিনি অসহায়ভাবে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। তিনি বলেন, হরতাল অবরোধে ঢাকায় হয়তো কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু জেলা শহরগুলোর অবস্থা বিপজ্জনক। এতে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। আমাদের যেভাবে হোক জেলা শহরগুলো সচল রাখতে হবে। সরকার রাজধানীর বাইরেও এই অচলাবস্থা কাটাতে পারবে কি-না তা নির্ভর করবে বিরোধী দলের আন্দোলনের কৌশলের ওপর।

অর্থমন্ত্রী এর আগে ১৫ জানুয়ারি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রত্যাশা করছি পরিস্থিতি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক হবে। না, তার এই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। যেমন কথা রাখতে পারেননি আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উল আলম হানিফ। ১৯ জানুয়ারি তিনি বলেছিলেন, কথা দিলাম আগামী সাত দিনের মধ্যে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এখন অবশ্য তিনি বলছেন, বিএনপি একটি বড় দল তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম দমন করতে বেশ কিছু সময় লাগবে। আর বিজিবির মহাপরিচালক ২৮ জানুয়ারি বলেছিলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক আর কেউ বার্ন ইউনিটে আসবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আরো বহু লোক বার্ন ইউনিটে এসেছে। এই ঘোষণার পর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, গাইবান্ধার তুলসীঘাট এবং গাজীপুরে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। দুঃখজনকভাবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিট হয়েছে এখন ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির কেন্দ্র। বিরোধী দলের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেশে এখন যে ‘নাশকতা সাংবাদিকতা’ চলছে তারও কেন্দ্র হয়ে উঠেছে বার্ন ইউনিট। পেট্রলবোমায় দগ্ধ মানুষকে এখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে হচ্ছে। সেগুলোই আবার প্রপাগান্ডার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ এখন পর্যন্ত কোনো সংবাদপত্র ও টেলিভিশিন চ্যানেল অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারেনি যে কে পেট্রলবোমা মারল; বিএনপির নেতারাই বা কিভাবে কবে কখন কাকে নির্দেশ দিয়ে হুকুমের আসামি হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেন তার তথ্য প্রমাণ হাজির করা যায়নি।

এসব পেট্রলবোমা হামলার সাথে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে প্রচারণা চালানো হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও ধরা পড়েছে। মানুষের জীবনহানি ঘটে এমন হামলা নিয়ে দোষারোপের রাজনীতির কারণে প্রকৃত অপরাধীরা যেমন আড়ালে থেকে যাচ্ছে তেমনি এর রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিরোধী দলকে দায়ী করে মন্ত্রী-এমপিদের প্রবল প্রচারণার মধ্যেও বিস্ময়কর কিছু খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। যেমন চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কার্যালয় থেকে বিপুল পরিমাণ পেট্রলবোমা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বোমা ও পেট্রলবোমাসহ যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মী আটকের খবর প্রকাশ হয়েছে। রাজধানীর কাছাকাছি রূপগঞ্জে বোমা বানানোর সময় ছাত্রলীগের একজন নেতা নিহত হয়েছেন। এসব বোমা উদ্ধারের ঘটনা প্রমাণ করে সহিংসতার ঘটনার সাথে ক্ষমতাসীনেরাও জড়িত রয়েছেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যানবাহন ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার সাথে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও জড়িত রয়েছেন।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব আর ক্ষমতাসীনদের নৈতিক কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কাছে কেন বোমা পাওয়া যাচ্ছে? তাদের কাছে যখন বোমা পাওয়া যায় তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে যায়। অর্থমন্ত্রীর উপলব্ধির সত্যতা প্রমাণ করে যে, আসলে দেশের অবস্থা ভয়ঙ্কর।

ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বর্তমান সঙ্কটকে রাজনৈতিক সঙ্কট হিসেবে মানতে রাজি নন। তারা বর্তমান পরিস্থিতিকে দেখছেন আইনশৃঙ্খলা জনিত সমস্যা হিসেবে। এর সমাধান তারা খুঁজছেন বন্দুকের নলে। প্রথম প্রকাশ্য গুলির ঘোষণা দিয়েছিলেন জাসদের নেতা ও সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন খান বাদল। ১৩ জানুয়ারি তিনি বলেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমে লাঠি দিয়ে মোকাবেলা করবে। পরে পায়ে গুলি করবে। পায়ে গুলি কাজ না হলে পরিস্থিতি বুঝে বুকে গুলি করবে। গণবাহিনীর নামে একসময়ের সশস্ত্র রাজনীতির প্রবক্তা এই নেতার তত্ত্ব আমরা পরবর্তীকালে প্রয়োগ হতে দেখছি। সরকারের একাধিক মন্ত্রী এখন তার সাথে দমন আর নির্মূলের রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন একই পথে চলছে। র‌্যাবের মহাপরিচালক প্রকাশ্যে বিরোধী দলের নেতাদের হুমকি দিয়েছেন জীবন নিয়ে আসতে হবে। ২৫ জানুয়ারি খুলনায় তিনি বলেন, অপরাধ দমন করতেই সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অস্ত্র দিয়েছে, হা-ডু-ডু খেলার জন্য নয়। না, না, হা-ডু-ডু খেলা নয় সত্যিই আমরা এখন চার দিকে বন্দুকবাজি দেখছি। তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর বিনাবিচারে ২৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিদিন এখন তিন থেকে চারজন লোক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হচ্ছেন।

পরিস্থিতি যে এমন পর্যায়ে যাবে পুলিশের বক্তব্যে আগেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল। ৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, একটি লাশ পড়লে এর পরিবর্তে দু’টি লাশ ফেলে দেয়ার ক্ষমতা পুলিশের আছে। আর চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার হাফিজ আক্তার ১৮ জানুয়ারি বলেছিলেন, কেউ যদি নাশকতার ঘটনা ঘটায় সাথে সাথে পুলিশ তাকে গুলি করবে। একই কাজ বিজিবি ও র‌্যাব করবে।

না, পুলিশ-র‌্যাব এই কাজ করতে পারে না। যেকোনো অপরাধী বা নাশকতাকারীকে পুলিশ আটক করে আইনের আওতায় আনবে। তার যদি মৃত্যুদণ্ড হয় তাহলে হতে হবে বিচারের মাধ্যমে। পুলিশের যেহেতু বিচার করার অধিকার নেই, সে কারণে পুলিশ কাউকে হত্যা বা পায়ে গুলি করে শাস্তি দিতে পারে না। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এমন কাজ করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। দেশের প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলার জন্য বিএনপির চেয়ারপার্সেন বেগম খালেদা জিয়াসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এখন বন্দুকযুদ্ধের নামে বিনাবিচারে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের হত্যার জন্য কাকে হুকুমের আসামি করা হবে? বিরোধী দলের আন্দোলন দমনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেভাবে হত্যার লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে ভবিষ্যতে এর পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড সুশৃঙ্খল বাহিনীর পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সক্ষমতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমাসহ ক্ষমতাসীন দলের যেসব নেতাকর্মী আটক হয়েছেন তারাও তো বোমাবাজ। তারাও তো পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু এদের কেউ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হননি। তাদের পায়ে গুলি করা হয়নি। আমরা মনে করি পুলিশ তা না করে যথাযথ কাজ করেছে। কিন্তু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুলি করার যে প্ররোচনা দেয়া হয়েছে একই কাজ যে ভবিষ্যতে পুলিশ অন্যদের প্ররোচনায় করবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?

ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন মন্ত্রী ও বুদ্ধিজীবী প্রতিনিয়ত বলে চলছেন বিএনপি-জামায়াতকে নির্মূল করা হবে। দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট। এই মুহূর্তে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলগুলো তার বড় প্রমাণ। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক কর্মী ও নেতৃত্ব পর্যায়ে রয়েছে পারস্পরিক আত্মীয়তার যোগাযোগ। ভাষা, জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ে তারা এক ও অভিন্ন। তাহলে কিভাবে পরস্পরকে নির্মূল করা সম্ভব?

সাম্প্রতিক সময়ে জাতিগত সঙ্ঘাত থেকে নির্মূলের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল বসনিয়া হারজেগোভিনায়। সেখানে ৪৮ শতাংশ মুসলিম, ৩৭ শতাংশ সার্ব আর ১৭ শতাংশ ছিল ক্রোট। জাতিগত নির্মূল অভিযানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরেও কাউকে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। বসনিয়ার মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে হয়েছে। বাংলাদেশে এই নির্মূলের রাজনীতির ডাক যারা দিচ্ছেন তারা প্রকৃতপক্ষে দেশকে সঙ্ঘাতের মুখে ফেলে দেয়ার জন্য এমনটি বলছেন।

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে কখনোই নির্মূলের রাজনীতি সফল হবে না। আওয়ামী লীগের ভেতরের একসময়ের উগ্রবামপন্থীরা হচ্ছেন এই নির্মূলের রাজনীতির হোতা, যারা কখনোই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সক্ষমতা রাখেন না। আওয়ামী লীগের কাঁধে বন্দুক রেখে এরা রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণ করছে। আওয়ামী লীগের নেতারা ভালোভাবে উপলব্ধি করেন যে, দলটির জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। উগ্রবাদীদের পরামর্শে বন্দুকের জোরে জোরপূর্বক ক্ষমতায় থাকার নীতি তাদের আরো বেশি সঙ্কটের মুখে ফেলবে। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণে জনগণের সাথে সম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। সন্দেহ নেই আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি বিশাল তরুণ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেছে। যাদের সামনে রয়েছে উজ্জ্বল রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ তারা কেন উগ্রবাদীদের ইচ্ছার পুতুল হবে? জবরদস্তিমূলক শাসনের দায় বহন করে নিশ্চয়ই এই তরুণ নেতৃত্ব রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন করবে না।

বিরোধী দলের রাজনৈতিক আন্দোলনকে যতই সন্ত্রাসী ও জঙ্গি আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হোক না কেন এর সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। জনগণের প্রবল সমর্থন আছে বলে এক মাসের বেশি সময় ধরে অবরোধ চলছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন এ দেশে ব্যর্থ হয়নি। ’৯০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত যতবার রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে প্রতিটি আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের দাবি মানতে হয়েছে। এরপর নির্বাচন হয়েছে। রাজনৈতিক আন্দোলন ব্যর্থ হয় না। কারণ সময় যত যাবে সাধারণ মানুষ ততই সরকারের বিপক্ষে চলে যায়। কিন্তু আন্দোলন দীর্ঘায়িত করার কারণে ক্ষতির পরিমাণ শুধু বাড়তে থাকে। ক্ষমতাসীনেরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বাস্তবতা উপলব্ধি করে যত দ্রুত সঙ্কট নিরসনের উদ্যেগ নেবেন ততই মঙ্গল।



মন্তব্য চালু নেই