বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কুৎসার কথা ফাঁস করে দেব : লন্ডনে রব

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ, লন্ডন থেকে : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন বলেই বাঙালি জাতি একজন বঙ্গবন্ধু পেয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘সেই সিরাজুল আলম খানকে উদ্দেশ করে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী বিভিন্ন পত্রিকায় অশ্লীল ভাষায় যেসব লেখা লিখেছেন, তা প্রত্যাহার করে তাকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। নতুবা ৬০ এর দশক থেকে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোথায় কী কুৎসা রটিয়েছেন, তা ফাঁস করে দিতে বাধ্য হব।’

২৭ আগস্ট লন্ডনের বেতার বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জেএসডির সভাপতি, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি আ স ম আবদুর রব কথাগুলো ব্রিটেনপ্রবাসী জনগণের উদ্দেশে তুলে ধরেন ।

আ স ম আবদুর রবের এই সাক্ষাৎকার যখন বেতার বাংলায় প্রচার হচ্ছিল, তখন দেশ-বিদেশের হাজারো বাংলাদেশি বেতার বাংলায় টেলিফোনে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তারা আ স ম আবদুর রবের এই সাক্ষাৎকারের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছিলেন।

বেতার বাংলার উপস্থাপক সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদের ‘মর্নিং এক্সপ্রেস উইথ সেলিম’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে আ স ম আবদুর রবের দেওয়া সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো :

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, সিরাজুল আলম খান স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিউক্লিয়াস থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কখন কী করেছেন, কেমন করে ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন, ২ মার্চ, ৩ মার্চ, বিএলএফ, মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল কখন কীভাবে কী হবে- সেসব আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর পক্ষে জানা সম্ভব নয়, ছিলও না। গাফ্‌ফার ভাই একজন লেখক, সাংবাদিক, বয়োবৃদ্ধ লোক। আমি তাকে ভালোবাসি। আমরা তার লেখা গান পছন্দ করেছি। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, তার মনে যা আসে, যা তার মতের সঙ্গে মেলে না বা স্বার্থের ওপর আঘাত আনে- সেসবের বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম রূপকার সিরাজুল আলম খানকে মূর্খ, ভণ্ড ইত্যাদি অশালীন শব্দ ব্যবহার করে জাতীয় পত্রপত্রিকায় মনের রং লাগিয়ে লিখবেন। আর বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে যারা জড়িত তারা চুপ করে বসে থাকবেন?’

সিরাজুল আলম খান কেমন ছাত্র ছিলেন- সেটা গাফ্‌ফার চৌধুরীর কাছ থেকে আমাকে জানতে হবে না। সিরাজুল আলম খানের পাণ্ডিত্য, জ্ঞান, গরিমা, নতুন নতুন রাজনৈতিক তত্ত্ব, তথ্য, চিন্তা-ভাবনা দেশ-বিদেশে সকল সময়ই আলোচিত হয়েছে।

সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদ বুলবুলের জাসদ ও কর্নেল আবু তাহেরকে নিয়ে মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এক প্রশ্নের জবাবে আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘এ সময় আমি জেলের মধ্যে ছিলাম। তখনকার সরকার ধোঁকার মাধ্যমে আমাকে অসুস্থ সাজিয়ে জার্মানি পাঠায়। তবে মহিউদ্দিন বুলবুল আমাদের দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বুলবুল আমাদের দল করতেন।’

‘৭ নভেম্বর এবং কর্নেল তাহের ও জাসদ নিয়ে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন- সেটা নিয়ে তার রচিত বই এখনো যেহেতু প্রকাশিত হয়নি, সে জন্য অপ্রকাশিত বই নিয়ে মন্তব্য করাটা এখনই ঠিক হবে না। বাজারে বইটি আসুক, তারপর সেটা পড়ে নিয়ে মন্তব্য করা যাবে। প্রথম আলোতে তিনি যে লেখা দিয়েছেন, সেটা নিয়ে এটাই বলব, তিনি সেই তথ্য কোথায় পেয়েছেন, সেটা জাতিকে তাকেই জানাতে হবে। কেননা, সে তথ্য তিনিই বলেছেন। তার সেই তথ্য কতটুকু সঠিক, সেটাও দেখতে হবে। কেননা বানানো ও মনগড়া তথ্য দিয়ে কিছুদিন বাজার গরম করা যায়। জনগণের মনে রেখাপাত করা যায় না।’

রব বলেন, ‘ইতিহাসের সত্যতা কেউ লুকিয়ে কিংবা নিজের মতো করে প্রচার করে অতীতে পার পায়নি, বর্তমানেও সম্ভব হবে না। কেননা যেটা সত্য ইতিহাস, সেটা ১০০ বছর পরে হলেও বের হবে। ৭ মার্চ, ২ মার্চ, ৩ মার্চের ইতিহাস- যুগের পর যুগ ধরে স্বার্থবাদীরা লুকিয়ে ও মিথ্যে তথ্য দিয়ে বইপুস্তক ভরে রেখেছিল। অথচ ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে সেটা প্রকাশিত হয়েছে।’

এ সময় আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে সিরাজুল আলম খান সত্য ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। ২ মার্চের পতাকা উত্তোলনের ইতিহাস জাতি এখন অবগত। এই সব সত্য ইতিহাস যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখনি একের পর এক স্বার্থবাদী আর মিথ্যের ফেরিওয়ালাদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেছে। তারা একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছে।’

আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘যার স্বার্থে যত আঘাতই লাগুক, জাতিকে, নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানার সুযোগ করে দিতে হবে।’

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ও বিচারপতিদের অভিশংসন নিয়ে মন্ত্রিপরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাবিত আইনের ব্যাপারে বেতার বাংলার উপস্থাপকের এক প্রশ্নের জবাবে আ স ম আবদুর রব  ড. কামাল হোসেনের সাম্প্রতিক একটি লেখা, যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেটার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘দেশে বর্তমানে এক শ্বাসরুদ্ধকর এবং রাজনীতিকে বিরাজনীতিকরণের অবস্থা চলছে। গণতন্ত্রের নামে এক ব্যক্তির খেয়ালখুশিমতো একধরনের গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরাচারী শাসন চলছে। বিরুদ্ধ মত ও পথ দমন, নিপীড়নের জন্য ব্যক্তিস্বাধীনতাকে হরণ ও জনমতকে স্তব্ধ করে কেবলমাত্র একজনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলনের জন্য একধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেশে গুম, খুন, হত্যা, রাহাজানি বেড়েই চলছে। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের সকল ব্যবস্থাই করা হয়েছে।’

আ স ম আবদুর রব বলেন, গত ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে- সেটা অত্যন্ত কলঙ্কজনক এক অধ্যায়। ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত- ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে অর্ধেকেরও বেশি এভাবেই নির্বাচিত আর বাকি যারা নির্বাচিত বলা হচ্ছে তারাও ৫ পার্সেন্ট ভোট পেয়েছে বলে নিজেরাও দাবি করতে পারছে না, অথচ সেই ৫ পার্সেন্ট ভোটকে এখন রং লাগিয়ে ৪০ পার্সেন্ট বানানো হচ্ছে। এ ধরনের নির্লজ্জ নির্বাচন বিশ্বের কোথাও হয়নি। দেশের আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ সবই আজ সর্বত্র স্বজনপ্রীতি আর দলীয়করণ চূড়ান্তভাবেই করা হয়েছে। কোথাও জবাবদিহির বিন্দুমাত্র রেশ নেই। সমালোচনা করলেই তার ওপর নেমে আসছে জেল-জুলুম, মামলা-মোকদ্দমা, আক্রমণ। দেশে যখন রাজনীতি থাকে না তখন এ ধরনের বিরাজনীতিকরণের দিকেই নিয়ে যাওয়া হলে সর্বত্র নেমে আসে ধ্বংস। আর সেই ধ্বংস যখন নেমে আসবে তখন হবে আরো ভয়াবহ অবস্থা।

এ থেকে উত্তরণের পন্থা প্রসঙ্গে আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে ১৯৭২ সালের জোড়াতালি দেওয়া সেই সংবিধান। এই সংবিধান বিগত ৪৪ বছরেও বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা কিছুই পূরণ করতে পারেনি। এই সংবিধান বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান কাউকেই রক্ষা করতে পারেনি। সে জন্য এই সংবিধানের আমূল পরিবর্তন করে সকল শ্রেণি, পেশা  ও কর্মের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার আলোকে এবং পার্লামেন্ট ও প্রশাসনে শ্রম-কর্ম-পেশার জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে।

আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘রাজনৈতিক সংকটের যে কারণ, সেই তত্ত্বাবধায়কের বিকল্প পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষ বা আপার হাউস গঠন করে এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। আমাদের ক্রমবর্ধমান জনগণের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে পার্লামেন্টের আসন বৃদ্ধি করে ৫০০তে উন্নীত করে সকল শ্রম-কর্ম-পেশার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনী ব্যবস্থায় রি-কল (প্রত্যাহার) ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে আ স ম আবদুর রব বলেন,  ‘সমস্যার মূল কারণ অনুসন্ধান ও সমাধানের পরিবর্তে ২০৪০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার উচ্চাভিলাষী মানসিকতা থেকেই মেট্রোরেল, হাইওয়ে, পদ্মা, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট, আকাশ রেল, ফ্লাইওভার, উচ্চমধ্যবিত্তের দেশে পরিণত হওয়া ইত্যাদি নানামুখী চমকপ্রদ স্বপ্ন ও আশাজাগানিয়া প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। আগামী ১০০ বছর পরে বা ৫০ বছর পরে সেই সব প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য কী পরিণতি বয়ে নিয়ে আসবে, তা ভাবা হচ্ছে না। সেই সবকিছুই মূলত সুপার কমিশন আর নিজেদের পকেট ভারী করার আধুনিক টেকনিক ছাড়া আর কিছুই নয়।’

‘একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহর জলাবদ্ধতায় তলিয়ে যায়। বাংলাদেশের আয়ের অন্যতম খাত গার্মেন্ট শিল্পে অস্থিরতা আর ধ্বংসের সকল ব্যবস্থা করে সেসব নিরসন না করেই আকাশচুম্বী অবাস্তব স্বপ্ন জাতিকে দেখানো হচ্ছে কমিশন বাণিজ্য ঠিক রাখার জন্য।’

আ স ম আবদুর রব তার সাক্ষাৎকারের শেষ পর্যায়ে এসে আবারও প্রবাসী সব বাংলাদেশিদের এবং রেডিও স্রোতা ও অনলাইনের মাধ্যমে যারা এই অনুষ্ঠান শুনেছেন সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং প্রবাসীদের দেশ ও জনগণের উন্নয়নে সঠিক পদক্ষেপ এবং সহযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। বেতার বাংলার মাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্যও আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।



মন্তব্য চালু নেই