বঙ্গবন্ধুকে এবার “পাকবন্ধু” বললেন তারেক

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু নয়, পাকবন্ধু। জাতির জনক নয়, জাতির হত্যাকারী। তিনি বলেন, ‘৭ মার্চে পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দিয়ে শেখ মুজিব বক্তৃতা শেষ করেছেন। ২৫ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, এটি তার বিরুদ্ধে দেশোদ্রোহিতার দলিল হয়ে থাকবে। এরপর তিনি স্বাধীনতাকামীদের নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তাই সঙ্গতকারনেই বলা যায়, শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু নয় পাকবন্ধু।

সোমবার পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীনে ইয়র্ক হলে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বিশ্বনেতা শহীদ জিয়াউর রহমান : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

তারেক রহমান  বলেন, শেখ মুজিব ৭ মার্চ কিংবা ২৫ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে মুক্তিযুদ্ধে এতলোক মারা যেত না। যার অদূরদর্শিতা কিংবা আপোসকামিতার ফলে মুক্তিযুদ্ধে এত লোকের প্রাণহানি হয়েছে।  তিনি ‘জাতির জনক’ হতে পারেন না। তিনি হত্যাকারী।

তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরেন শেখ মুজিব। এসেই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রকে পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি থেকে দুদিন পরই প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান। সংবিধানের এতবড় মৌলিক পরিবর্তনের সময়ও তিনি জনগণের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে স্বাধীন হওয়ার পর যিনিই পাকিস্তানের পাসপোর্ট গ্রহণ করেন আইনের দৃষ্টিতে তিনি সেই দেশেরই নাগরিক। একজন পাকিস্তানের নাগরিক কীভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী হলেন, আজ হোক কাল হোক সেই প্রশ্নের জবাব অবশ্যই জনগণের সামনে দিতে হবে।

সভায় তারেক রহমান ১৯৭৩ সালে তৎকালীন ছাত্রনেতা বর্তমানে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলামের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেন, ‘৭৩ সালে ৩ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, দেশের জনগণ এবং গণমাধ্যমের কাছে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ছাত্র হত্যার অভিযোগে শেখ মুজিবের সব পদবী প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। কেউ যেন শেখ মুজিবের নামের আগে বঙ্গবন্ধু কিংবা জাতির জনক না বলেন, না লেখেন।

তারেক রহমান বলেন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের দুঃশাসনে আওয়ামী লীগের গর্ব করার কিছু নেই। বরং শেখ মুজিব আওয়ামী লীগকে সাংবিধানিকভাবেই নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এখন শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডই আওয়ামী লীগের রাজনীতির একমাত্র পুঁজি।

তারেক রহমান বলেন, গত কয়েকমাস আমি বেশ কয়েকটি বক্তৃতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পূর্বাপর ঘটনা এবং ইতিহাস বিকৃতির আড়ালে পড়ে থাকা কিছু কঠিন সত্য তুলে ধরেছি। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তির বিপরীতে কিছু ব্যক্তি লাফঝাপ করেছে। কারণ তাদের কোনো যুক্তি নেই। আবার যুক্তি দিলেও শেখ হাসিনার কাছে মুক্তি নেই।

তিনি বলেন, ইতিহাসের কোনো সত্য শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে গেলেই আওয়ামী লীগ এবং তাদের অনুগতরা তাকেই রাজাকার হিসাবে অপপ্রচার চালায়। তারা এরইমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের কমপক্ষে ছয় জনকে রাজাকার অপবাদ দিয়ে ফেলেছে।

তিনি বলেন, ‘একটি বই লিখে মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক একে খন্দকার রাজাকার আর বেয়াই খন্দকার কিংবা নুরা খন্দকার নির্দোষ। তারেক রহমান বলেন, ধীরে ধীরে ইতিহাসের সত্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। হুমকি ধামকি কিংবা র‌্যাবের বন্দুকের ভয় দেখিয়ে সত্য আড়াল করে রাখা যায় না।

তারেক রহমান বলেন, শেখ হাসিনার কথার খুব একটা গুরুত্ব জনগণের কাছে নেই। সবসময়ই কোনো ঘটনাকে নিয়ে বাচালতা করা তার স্বভাবসিদ্ধ। কিন্তু জনগণের ভয়টা অন্যখানে, তা হলো, বর্তমানে রাষ্ট্র ক্ষমতা এমন একজনের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে যাকে ২০০০ সালে বাংলাদেশের সর্ব্বোচ্চ আদালত ‘রং হেডেড’ বলেছিল, যিনি ‘হাবরিস সিনড্রমে’ আক্রান্ত কি না সেটি পরীক্ষার জন্যও বিভিন্নমহল থেকে দাবি উঠেছে।

তিনি বলেন, বর্তমান অবৈধ সরকারের দীর্ঘদিন ক্ষমতা আকড়ে থাকার পরিকল্পনা কল্পনায় পরিণত হতে আর খুব বেশি সময় নেই। দেশের জনগণ তাদের সঙ্গে নেই। বিদেশের কাছে ধর্না দিয়েও অবৈধ সরকারের বৈধতার সার্টিফিকেট আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিএনপি প্রতিদিনই আওয়ামী লীগের দূরাচার অনাচার আর গণতন্ত্রহীনতার কথা তুলে ধরছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছে এটি আন্দোলন মনে হচ্ছে না। তাদের কাছে অন্দোলন মানে লগি বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা করা। আওয়ামী লীগ যে বিএনপির আন্দোলন টের পাচ্ছে না এটিও বিএনপির অন্দোলনেরই অংশ। যখন টের পাওয়া শুরু করবে তখন তাদের পালানোর পথ থাকবে না।

সমাবেশে তারেক রহমান বলেন, যারা শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল, ক্ষমতার লোভে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বহীন মিডিয়া নির্ভর সেইসব ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে নিজেদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে শেখ হাসিনা এখন জিয়াউর রহমান ও তার পরিবার এবং বিএনপিকে তাদের অপপ্রচারের টার্গেট করেছে।

তিনি বলেন, অপপ্রচার চালিয়েও শেখ হাসিনা শিকাগোতে জিয়াউর রহমানের নামে সড়কের নামকরণ ঠেকাতে পারেননি। দেশে বিদেশে জিয়াউর রহমানের অবদান স্বীকৃত হচ্ছে। জিয়াউর রহমানের জীবন ও কর্মের স্বীকৃতির জন্য আদালতের রায়ের প্রয়োজন নেই।

তারেক রহমান বলেন, কোনো একটি সরকারের নৈতিক ও আইনগতভিত্তি দুর্বল হলে এবং জনমর্থন না থাকলেই সরকার আইনের দোহাই দিয়ে বেআইনিভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আসলে এই সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা নেই।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্য আর নিরাপদ নন, তার কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিরাপদ নয়, গণতন্ত্র নিরাপদ নয়, নিরাপদ নয় বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ।

তারেক রহমান বলেন, ‘জাতিসংঘ যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিয়েছে হাসিনার এমন মিথ্যাচারেরও জবাব দিয়েছে দেশগুলো। এতে হাসিনা লজ্জা না পেলেও দেশের নাগরিকরা বিব্রত। হাসিনা এখন জঙ্গি জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন। এটি হাসিনার কূটকৌশল। তার বাবাও নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে জনগণকে বাকশালের ভয় দেখাতেন।

তারেক রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘হাসিনা বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে চায়। এবারও জাতিসংঘে গিয়ে তিনি সেটি করে এসেছেন। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না। তাই বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদমুক্ত রাখতে হলে দলমত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে হাসিনার বিরুদ্ধে গণঅঅন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া এখন সময়ের দাবি।

তারেক রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ কখনোই জনগণের মনের ভাষা বুঝতে পারেনি। তারা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ কিংবা ২৫ মার্চেও স্বাধীনতাকামী জনগণের ভাষা বোঝেনি। তেমনি বুঝতে পারেনি স্বাধীনতার পরও। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী লাখো জনতাকে নিরাপদ মনে করেনি শেখ মুজিব, তিনি নিরাপদ মনে করেছেন হানাদার বাহিনীকে।

তিনি বলেন, শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনা তারা কখনোই জনগণের সমর্থনের উপর ভরসা রাখেনি। এ কারণে শেখ মুজিবের স্বীকৃতি আদায়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে।

তারেক রহমান বলেন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জিয়াউর রহমান একটি অবিসংবাদিত নাম। ২৫ মার্চ হঠাৎ করেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। হঠাৎ করেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে জীবনবাজী রাখেননি। বাংলাভাষা ও তৎকালীন সময়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের চেতনা তিনি লালন করেছেন ছাত্রাবস্থা থেকেই।

তিনি বলেন, বিচারপতি সায়েমের পদত্যাগের পর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন জিয়াউর রহমান। সেখানেও তিনি সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুচাতে সক্ষম হন।

তারেক রহমান বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়। সেই সময় আওয়ামী লীগ ছিল বিলুপ্ত। আর বিএনপির জন্মই হয়নি। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর তার মন্ত্রিসভার সদস্য বাকশাল নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ মোশাররফের ভাই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সংঘটিত এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন মুশতাক আহমদ। মুশতাককে সরিয়ে খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রপতি বানান শেখ মুজিবের নিয়োগ করা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি সায়েমকে। একইসঙ্গে মুশতাকের জারি করা সামরিক শাসনের আওতায় ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও নিযুক্ত হন বিচারপতি সায়েম। এর আগে ৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করেন খালেদ মোশাররফ। এরপর খালেদ নিজেই নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন। কিন্তু খালেদের ক্ষমতা ভোগ করার সৌভাগ্য হয়নি। তিনিও নিহত হন।

তারেক রহমান বলেন, কেন কীভাবে খালেদ মোশাররফ নিহত হয়েছিলেন এটি সেই সময়কার জঙ্গি নেতা ইনুকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।

তিনি বলেন, শেখ মুজিব সম্পর্কে তৎকালীন জঙ্গি নেতা বর্তমানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অক্ষম ছিলেন, তিনি বিরোধী আন্দোলনে ভীত হয়ে পড়তেন। মানুষের উপর তিনি একরকম জোরজবরদস্তি চালাচ্ছিলেন, তার মধ্যে সমালোচনা বা বিরোধীতা সহ্য করার শক্তি ছিল না।

সভায় সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি শায়েস্তা চৌধুরী কুদ্দুস। সভায় বক্তব্য দেন- বৃটেন সফরররত বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম উপদেষ্টা আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান, সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহিদুর রহমান, যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক এম এ মালেক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এ সালাম, তারেক রহমানের উপদেষ্টা হুমায়ুন কবীর এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অ্যাসিসট্যান্ট প্রেস সেক্রেটারি মুশফিকুল ফজল আনসারীসহ অনেকে।

সভা পরিচালনা করেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম কয়সর আহমেদ। সমাবেশে তারেক রহমানের হাতে সম্প্রতি শিকাগো সিটি প্রশাসনের স্থাপিত অনারারী জিয়াউর রহমান ওয়ের একটি নাম ফলক হস্তান্তর করা হয়। নামফলক হস্তান্তর করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনর সেক্রেটারি অব স্টেটের জেসিহোয়াইট কাউন্সিলের সদস্য ও জিয়াউর রহমান ওয়ের প্রস্তাবক শাহ মোজাম্মেল নান্টু।



মন্তব্য চালু নেই