ফেসবুক অশ্লীলতায় কিশোর-কিশোরীর সর্বনাশ

শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জন্য মোবাইল আর ফেসবুক আশীর্বাদ না সর্বনাশ? মোবাইলের কারণে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ফেসবুক নেশা এখন সর্বাধিক। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মোবাইল আসক্তি হাজার হাজার পরিবারকে ফেলেছে দুর্ভাবনায়। হঠাৎ চালু হওয়া ‘মোবাইল সংস্কৃতি’ বুঝতে শেখার আগেই ফেসবুক, গুগলে উলঙ্গ বেলেল্লাপনাপূর্ণ ছবির ছড়াছড়ি তরুণ-তরুণীদের কচি মন বিগড়ে দিচ্ছে। চরিত্র গড়ার আগেই নষ্ট হচ্ছে কিশোর-কিশোরীর চরিত্র।

নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে লেখাপড়ায় এবং পরিবার-সমাজে। জীবন গঠনের আগেই নতুন প্রজন্ম হারাচ্ছে পথের দিশা। বাবা-মায়ের ভাষায় অপরিণত বয়সে ছেলে-মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিষিদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সহজাত প্রবৃত্তির কারণে ছাত্রছাত্রীরা বইয়ের বদলে মোবাইলের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সুবিধায় ডিজিটালের নামে আগামীর প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়ার রহস্য কী? হুমায়ূন আহমেদের হিমু, মিছির আলীর চরিত্রের কারণে ক্লাসের পড়ার বাইরে সৃজনশীল বই পড়ে জ্ঞানার্জনের যে হিড়িক পড়েছিল ছেলেমেয়েদের মধ্যে, সেটা ধ্বংস করে দিচ্ছে মোবাইল সংস্কৃতি।

মুক্তবাজার অর্থনীতি চর্চা কি নতুন প্রজন্মের চরিত্রগঠন, মেধা-মনন ও সৃষ্টিশীলতাকে খাদের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে না? তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে মোবাইল এখন অপরিহার্য মাধ্যম। আগে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি ও টেলিফোন। গ্রাম দূরের কথা, শহরেও সবার ঘরে টেলিফোন ছিল না। চিঠির ওপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতিতে মোবাইল আসায় এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল শোভা পাচ্ছে।

মোবাইল মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্র খুবই সহজ করে দিয়েছে। সহজলভ্য হওয়ায় এই মোবাইলের ব্যবহার এমনভাবে বেড়েছে যে রাস্তার ভিক্ষুক থেকে শুরু করে ৭-৮ বছর বয়সী শিশুদের হাতেও মোবাইল শোভাবর্ধন করে। মোবাইল ও ফেসবুক যুগের আগে ছেলেমেয়েরা রাতে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ত। এখন মোবাইল টিপতে টিপতে ঘুমিয়ে পড়ে। ব্লগ, ফেসবুক ও টুইটার ব্যবহারের কারণে শিশু-কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের ধ্যান-জ্ঞান হয়ে পড়েছে মোবাইল।

দ্রুত যোগাযোগে মোবাইল আশীর্বাদ হলেও অনেকের জন্য হয়েছে সর্বনাশ। এখন বই পড়ে জ্ঞানার্জন যেন ভুলতে বসেছে কিশোর-কিশোরীরা। অথচ কয়েক বছর আগেও বই পড়ার হিড়িক দেখা গেছে শহুরে ছেলেমেয়েদের মধ্যে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। ক্লাসের বাইরে জ্ঞানার্জনে বই পড়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ায় হুমায়ূনের উপন্যাসের হিমু, মিছির আলী, শুভ্র, বাকের ভাই, রুপা চরিত্রগুলোর অনুকরণ শুরু হয়েছিল সমাজে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে শিল্পসাহিত্যের সমঝদারদের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা যায়।

কিন্তু হঠাৎ করে মোবাইল, গুগল, ফেসবুক ইত্যাদি বইয়ের প্রতি তরুণ-তরুণীদের আগ্রহে ধস নামিয়ে দেয়। মোবাইলে আকৃষ্ট হয়ে পড়ায় মেধা বিকাশে যে বই পড়া অপরিহার্য সেটা ক্রমশ কমে আসছে। কয়েক বছর আগেও পাড়া-মহল্লায় ক্লাব-পাঠাগার গড়ে বই পড়ার প্রবণতা তরুণদের মধ্যে দেখা যেত। এখন তা উঠে যাচ্ছে। কম বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে কিশোর পত্রিকার পড়তে হুড়োহুড়ি লেগে যেত। স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা অনেক কষ্টের পয়সা জমিয়ে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে একটা পত্রিকা কিনে সেটা পড়ার জন্য হুড়োহুড়ি করত। দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও বই পড়তে লম্বা লাইন লেগে যেত স্কুল-কলেজের ক্লাব-পাঠাগারে।

শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরি, ওসমানী উদ্যানে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের লাইব্রেরি, ব্রিটিশ কাউন্সিলে প্রচুর ছেলেমেয়ে বই পড়ত নিয়মিত। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাইয়িদের নেতৃত্বে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র বই পড়ার প্রতিযোগিতা ফেরি করত। অথচ এখন ম্যাগাজিন ও বইয়ের দিতে তাকাতেই দেখা যায় না কিশোর-কিশোরীদের। বরং তারা মোবাইলে ফেসবুক নিয়ে আসক্ত থাকে। ঢাকার একটি নামকরা কলেজের প্রায় তিনশ ছাত্র গত সপ্তাহে শিক্ষা সফরে কক্সবাজার যায়। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল প্রত্যেক ছাত্রের হাতে ২-৩টি করে মোবাইল। সবার কানে ইয়ারফোন।

শিক্ষকদের সামনেই ছাত্রদের কেউ ফোন টিপছে, কেউ গান শুনছে, কেউ ফোনে গেম খেলছে। তিনশ ছাত্রের মধ্যে মাত্র ২-৩ জন ছাত্রের হাতে বই দেখা গেল। অথচ কয়েক বছর আগেও চিত্র ছিল উল্টো। ভবিষ্যতের জীবন গঠনে বই যাদের নিত্যসঙ্গী হওয়ার কথা তাদের সঙ্গী হয়ে গেছে মোবাইল। প্রশ্ন হলো মোবাইল কি সবার জন্য অপরিহার্য? সিম কার্ডের রেজিস্ট্রেশন আর আঙ্গুলের ছাপ নেয়ার মধ্যেই কি রাষ্ট্রের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ? একটি ছুরি ডাক্তাদের হাতে পড়লে তা রোগীর অপারেশনে ব্যবহৃত হয়, কসাইয়ের হাতে পড়লে গরু জবাইয়ে ব্যবহৃত হয়, ডাকাতের কবলে পড়লে খুন-খারাবিতে ব্যবহৃত হয়। ব্যবহারে ছুরির দোষ নয়, দোষ ব্যবহারের ধরনের।

কাজেই মোবাইল খারাপ নয়, কিন্তু তার ব্যবহার কীভাবে হচ্ছে সেটা রাষ্ট্রের দেখা জরুরি। ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়া ছাত্রছাত্রীদের দেখা যায় বাসে, রিকশায় বা পায়ে হেঁটে চলার সময় কেউ ফোনে কথা বলছে, কেউ গান শুনছে। এটা নিত্যদিনের চিত্র। আগে ছেলেমেয়েরা ক্লাসের পড়ার পাশাপাশি অবসরে সৃজনশীল বই পড়ত। এখন ক্লাস সিলেবাসের বাইরে যেন পড়ার কিছু নেই। তারা মোবাইল, ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে টিভির দেখে সময় পার করে।

অপরিণত বয়সে মোবাইল আসক্তি ঢাকা কত হাজার ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছে সে খবর কে রাখে? বইমেলায় গিয়ে দেখা গেল শিশুরা মেলায় বেশিরভাগই কার্টুনের বই কিনছে। টিভিতে তারা যেসব কার্টুন দেখে, মেলায় সে বইয়ের খোঁজ করে। আকাশ সংস্কৃতির কারণে হিন্দি ভাষার কার্টুন টিভিতে দেখায় তাদের পছন্দ বিদেশি কার্টুনের ‘দেশি’ ভাষার বই। বাসায় সারাক্ষণ যে কার্টুন দেখে, মেলায় এসেও সেই কার্টুনের বই ঘুরেফিরে কিনছে। যে বাবা-মা নিজেরাই অবসরে বই পড়েন না, বড় ভাইবোন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, সে পরিবারের শিশুরাও মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়। বড়দের দেখে দেখে শিশুরা শেখে।

ঘরে বাবা-মা বই না পড়ে টিভি দেখেন, সিনেমা দেখেন, সিরিয়াল দেখেন, মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, শিশুটিও একসময় পুরোপুরি প্রস্তুত হয় সে জগতেই। সবার হাতে মোবাইল। বুঝতে পারুক না পারুক মোবাইল চাই-ই! অনেক অভিভাবক গর্ব করে বলে থাকেন ছেলে-মেয়ে আমার চেয়েও মোবাইল ‘ভালো অপারেট’ করতে পারে। বাবা মায়েরা নিজেদের দায়িত্ব ফাঁকি দিতেও অবুঝ শিশুদের হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছেন, গর্ব করছেন। কে কত দামি ফোন কিনে দিচ্ছেন সেটা নিয়ে প্রচারণার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন মায়েরা। বইয়ের রাজ্যের জ্ঞানার্জন নয়, ছেলে-মেয়েরা বড় হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির মোবাইল ‘মিথ’-এর মধ্যে।

এই মিথে সে এমনভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে, যেখানে সে নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলছে ফেসবুক-টুইটার আর গুগল রাজ্যে। ফেসবুকে নেশাগ্রস্ত ছেলেমেয়েরা মোবাইল ছাড়া এক দিনও চলতে পারছে না। অথচ মেধা বিকাশের জন্য তার প্রয়োজন ক্লাসের বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। বই পড়ে যে জ্ঞানার্জন করা যায় অন্য কিছুতে সেটা সম্ভব নয়। মোবাইলের কারণে কত ছেলেমেয়ের শিক্ষা জীবন নষ্ট হচ্ছে সে খোঁজ কে রাখে! মোবাইলে ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়ার কারণে বুয়েটে পড়া তুখোড় ছাত্রের ক্লাস পরীক্ষায় বার বার ফেল করায় শিক্ষা জীবন নষ্ট হতে বসেছে।

নটর ডেম কলেজে পড়ুয়া একাধিক ছাত্রের ক্ষেত্রেও এ ঘটনা আছে। প্রশ্ন হলো তথ্যপ্রযুক্তিতে আমেরিকা কি বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে? আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর চেয়ে আর্থিকভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক হোসাইন ওবামা কি দুর্বল? ওবামার অর্থসম্পদ কম! আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বারাক ওবামার তার দুই মেয়ে মালিহা ও শাসাকে কত বছর বয়সে মোবাইল ব্যবহার করতে দিয়েছে? অথচ আমাদের দেশে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া ছেলেমেয়েদের হাতেও মোবাইল শোভা পায়। ওই শিশু-কিশোর-কিশোরী মোবাইল যথাযথ ব্যবহার করতে পারছে? নাকি মোবাইলের মাধ্যমে অপরিণত বয়সে গুগল, ফেসবুকে নোংরা ছবির অশ্লীলতায় আকৃষ্ট হয়ে নিজেকে ধ্বংস করছে?



মন্তব্য চালু নেই