মহৎ পেশার মানুষ

ফেল ছিল, ডবল প্রমোশনও ছিল : অধ্যাপক ডা. হাই

ছোটবেলায় বেবি ক্লাসে পড়ার সময় গরুর গাড়ি পায়ের ওপর পড়ে পা ভেঙে গিয়েছিল ছেলেটির। অসুস্থতার কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সে সময়। তবে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলে কী হবে, বিছানায় শুয়েই ক্লাসের সব পড়া শেষ করে ফেলেছিল সে! স্কুলে যখন ফিরে ফাইনাল পরীক্ষা দিল, দেখা গেল, সবচেয়ে ভালো নম্বর পেয়েছে সে। শিক্ষকরা বাবার কাছে চিঠি দিলেন। জানালেন, ছেলেটিকে ক্লাস টুতে ডবল প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। এতে ক্লাস ওয়ানে আর পড়া হয়নি তাঁর।

যার কথা বলছি, তিনি ক্যানসার চিকিৎসার প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এম এ হাই, জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। বর্তমানে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি হসপিটাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার হোমের পরিচালক। কলেজ অব ফিজিশিয়ান সার্জনস থেকে এফসিপিএস অনারারি পেয়েছেন তিনি। ৪৫ বছর ধরে রোগীদের সেবা দিয়ে যাওয়া মৃদুভাষী, সুহৃদ এই মানুষটি জানিয়েছেন তাঁর জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের গল্প।

প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা ছিল

পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ আমলে আমার জন্ম। এখন যেটা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর গ্রামে আমাদের বাড়ি। সেখানে বাবার জমিদারি ছিল। একান্নবর্তী পরিবার ছিল আমাদের। ছয় ভাই, তিন বোন ছিলাম। একান্নবর্তী পরিবারে সুখ-আনন্দে বড় হয়েছি আমি। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত মালদা মডেল মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছি। এরপর ক্লাস সিক্সে মালদা জেলা স্কুলে পড়ি। ১৯৫০ সালে ঢাকায় চলে আসি। ক্লাস সেভেন থেকে ঢাকায় পড়ি। এরপর নওয়াবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করি। আর জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি।

ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল না আমার কখনো, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। ঘুষ খাব, টাকা পয়সা হবে। হা হা হা…

১৯৫৭ সালে মাধ্যমিক পাস করার পরে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দিই। পাশাপাশি আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও (বর্তমানে বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষা দিই। মেডিকেলের ফলাফল আগে বেরিয়েছিল। মেডিকেলে টিকে গেলাম। ভর্তি হলাম, ক্লাস শুরু হলো। তখনো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফলাফল দেয়নি। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফলাফল দেওয়ার পর দেখা গেল সেখানেও চান্স পেলাম। তবে আর ভর্তি হওয়া হয়নি। মেডিকেলেই লেখাপড়া শুরু করলাম।

১৯৫৮ সালে তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। তখন তিনটি বছর নষ্ট হয় আমার। ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস পাস করি। এরপর এক বছর সার্জারিতে ট্রেনিং করি। ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে সরকারি চাকরিতে যোগ দিলাম। তেজগাঁওয়ে একটি আউটডোর ডিসপেনসারিতে পোস্টিং হয় আমার। ১৯৬৯ সালে পাস্টগ্রাজুয়েট শুরু করি। ১৯৭১ সালে পোস্টগ্র্যাজুয়েট শেষ করি।

ডা. এ বি এম এফ করিম এনাটমির শিক্ষক ছিলেন আমাদের। উনি ইংল্যান্ড থেকে ক্যানসার চিকিৎসায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসেছিলেন। ওনাকে দেখে মনে হয়েছে ক্যানসার বিষয়ে পড়ি।

১৯৭১-এর শেষের দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে রেডিওথেরাপি বিভাগে যোগদান করি। ১৯৭৩ সালে ডেনমার্কে রেডিয়েশন প্রোটেকশন ইন্সপেকশন অ্যান্ড সুপারভিশন বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিই। এরপর ১৯৭৪ ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগ দিই। ১৯৭৫-এ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করি। ১৯৭৯-এ সহযোগী অধ্যাপক হই। ১৯৮৬-এ অধ্যাপক হিসেবে বরিশাল মেডিকেল কলেজে চলে গেলাম। ১৯৮৭-এ জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটের পরিচালক হই। আমি দ্বিতীয় পরিচালক ছিলাম। এরপর ১৯৯৪ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে বদলি হই। ১৯৯৬ সালে আবার ক্যানসার ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে যোগদান করি। ১৯৯৮ সালে অবসর গ্রহণ করি।

ব্যর্থতা আছে জীবনে

জীবনে ফেল আছে, আবার ডবল প্রমোশনের ঘটনাও আছে আমার। জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটে থাকাকালীন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কাছ থেকে ৪.২ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রজেক্ট পাই। জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটের কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা করা সম্ভব হয়নি। এখানে নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। ক্যানসার ইনস্টিটিউটে রোগীদের সেবায় টিউমার বোর্ড চালু করি। এই বোর্ডের কাজ ছিল রোগীদের চিকিৎসা পরিকল্পনা করা। এই বিষয়ে নিজেকে সফল মনে হয়।

অবসর গ্রহণের পর আহসানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল চালু করেছি। এরপর ২০০৭ সালে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর গ্রামে খাজা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসার সেন্টার চালু করি। মঙ্গলবার সেখানে যাই, শুক্রবার ভোরে চলে আসি। ২০০৭ সালেই ঢাকায় ক্যানসার সোসাইটি অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার হোম হাসপাতাল শুরু করি।

একটি অনকোলজি ক্লাব করেছি আমরা। এর কাজ হলো অনকোলজি সার্ভিসের উন্নতি করা। ২০০১ সাল সার্ক ফেডারেশন অনকোলজি চালু করি।

রবিঠাকুরের গান পছন্দ করি

আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শুনতে পছন্দ করি খুব। এই গান মনের শক্তি জোগায়। সকাল বেলা উঠে ফজরের নামাজ পড়ে প্রতিদিন কোরআন শরিফ পড়ি; এটা আমার অভ্যাস। যখনই কোনো সমস্যায় পড়ি আল্লাহর ওপর ভরসা করি। আমি মনে করি, নিয়ত ভালো থাকলে কাজ হবেই।

আমার স্ত্রী তাহমিনা হাই ২০০২ সালে মারা গেছেন। তিন মেয়ে এক ছেলে আমার। বড় মেয়ে আর্কিটেক্ট, মেরিনা তাবাসসুম। সে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভের নকশা করেছে। মেজো মেয়ে চিকিৎসক। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। আর ছোট মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাস করেছে। ক্যানসার হাসপাতাল নিয়েই এখন ভাবনা, পরিকল্পনা আমার। যতদিন ঢাকায় থাকি এখানে সম্পূর্ণ সময় দিই।

বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার মান বাড়ছে

বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার মান বাড়ছে। তবে যে পরিমাণ রোগী সে অনুযায়ী চাপ নেওয়ার মতো অবস্থা এখনো হয়নি। বর্তমানে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য কয়েকটি সেন্টার হয়েছে, তবে জনবল ও যন্ত্রপাতির অভাব।

নতুন যারা এ পেশায় আসছে তাদের সিনসিয়ারিটির সঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রতিমুহূর্তে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। এই পেশাটি খুব দ্রুত এগোচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার হচ্ছে। একই চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে কাজে নাও লাগতে পারে। তাই প্রতিটি রোগীকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের ক্যানসার চিকিৎসাকে আরো এগিয়ে নিতে চাই-এখন এটাই আমার স্বপ্ন।এনটিভিঅনলাইন



মন্তব্য চালু নেই