ফের ৫ দিনের রিমান্ড: ‘অবৈধ সম্পর্ক আছে কিনা জানতে চাপ দিচ্ছে পুলিশ’

কিছুটা বিষণ্ন দেখাচ্ছিল তাকে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ভাবলেশহীন। রিমান্ড আবেদন ও বাতিলের শুনানি চলছে। দুপক্ষের আইনজীবীরা বিচারকের কাছে নিজ নিজ যুক্তি তুলে ধরছেন। এর মধ্যে বিচারক তাকে কাঠগড়ার সামনের দিকে ডেকে নিলেন। মাথা নিচু করে ছিলেন তিনি। দুবার ফুঁপিয়ে ওঠেন। তারপর আবার উদাস দৃষ্টি। যেন বুঝতেই পারছেন না কী নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি।

বিচারক তাকে জিজ্ঞাসা করলেন রিমান্ডে নিয়ে তাকে কোনো টর্চার বা চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে কি না? উত্তরে বলেন, ‘আমার সঙ্গে কারও সম্পর্ক আছে কি না তা জানতে প্রেসার দিছে’। বিচারকের কাছে আর কোনো অভিযোগ করেননি। অস্বীকার করেননি দুই সন্তানকে হত্যার কথাও।

গতকাল ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আলমগীর কবীর রাজের আদালতে চলছিল আলোচিত দুই সন্তান হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মা মাহফুজা মালেক জেসমিনের রিমান্ড শুনানি। আদালত শুনানি শেষে দ্বিতীয় দফায় তার ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে প্রথম দফা ৫ দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল দুপুর সোয়া ১টায় তাকে আদালতে নেয়া হয়। দুপুর ৩টা ১০ মিনিটে জেসমিনকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)’র পরিদর্শক লোকমান হেকিম।

শুনানির শুরুতেই কোর্ট পুলিশ বনশ্রীর আলোচিত দুই শিশু হত্যাকাণ্ডের আসামির দ্বিতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুরের আবেদন জানান। এর স্বপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, শুধু পড়াশোনার কারণে দুই সন্তানকে কোনো মা হত্যা করতে পারে না। এটা অবিশ্বাস্য। এর নেপথ্যে নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ রয়েছে। নেপথ্য কারণ বের করার জন্যই তাকে দ্বিতীয় দফায় ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন। এ সময় আদালতে আসামি পক্ষের আইনজীবী সাফায়েত আলী শুনানিতে অংশ নিয়ে রিমান্ড মঞ্জুরের বিরোধিতা করেন। তিনি আদালতকে বলেন, জেসমিন মানসিকভাবে অসুস্থ। তার চিকিৎসা করানো প্রয়োজন।

অসুস্থ মানুষের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। সুস্থ হওয়ার পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে। এজন্য তাকে রিমান্ডে না দিয়ে চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষ ও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরা রিমান্ড মঞ্জুরের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। বাদী জেসমিনের স্বামী ও নিহত দুই সন্তানের বাবা আমানউল্লাহ আমানের নিয়োগ করা আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার দিপু রিমান্ড মঞ্জুরের আহবান জানিয়ে বলেন, আসামি জেসমিনের চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজেই তা আবেদন করতেন।

তিনি সুস্থ। ইতিমধ্যে তিনি তদন্ত সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। দুই সন্তানকে নিজেই হত্যা করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। মেধাবী দুই সন্তানের একজন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ অন্যজন হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলো। নৃশংস এই ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচিত হচ্ছে। এ ঘটনায় আর কেউ জড়িত আছে কি-না, হত্যার প্রকৃত কারণ কী এসব জানা দরকার। ন্যায়বিচার ও সত্য উদঘাটনের স্বার্থে তার রিমান্ড মঞ্জুর করা প্রয়োজন বলে দাবি করেন তিনি।

একই ভাবে রিমান্ড মঞ্জুরের আবেদন জানিয়ে আইনজীবী হাজেরা বেগম আজরা বলেন, যে দুই শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে তারা দেশের সম্পদ। তিনি শুধু নিজের সন্তান হত্যা করেননি দেশের সম্পদ হত্যা করেছেন। এখন আমার সন্তান প্রশ্ন করে লেখাপড়া না করলে তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে। এই নৃশংস ঘটনার মোটিভ উদঘাটনের জন্য যতবার প্রয়োজন ততোবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

এসময় আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জেসমিন মানসিক রোগী বলে বারবার রিমান্ড নামঞ্জুর করার অনুরোধ করেন। এ পর্যায়ে বিচারক নথিপত্র ঘেঁটে এজাহারে ভালো রেজাল্ট না করার কারণে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি পড়ে দেখেন। পরে তিনি কয়েক দিন আগে বাবা-মা ও শিক্ষকদের পড়াশোনার চাপে এক ছাত্রের আত্মহত্যার বিষয়টি উল্লেখ করেন। বিচারক বলেন, আমাদের সমাজে পড়াশুনা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে।

সন্তানদের চাইতে মায়েরা বেশি চিন্তিত থাকেন। যেন মায়েরাই শিক্ষার্থী। কোনো হোমওয়ার্ক কখন, কীভাবে করতে হবে তা নিয়ে তারা বেশি টেনশন করে থাকেন। এ অবস্থায় বিচারক আসামি জেসমিনকে কাঠগড়ায় সামনের দিকে আসতে বলেন। আসামি জেসমিনকে কিছু সময় তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বিচারক আলমগীর কবির রাজ প্রথমেই জেসমিনের কাছে জানতে চান, আপনি কী জানেন এখানে কেন আনা হয়েছে আপনাকে?

জবাবে জেসমিন বলেন, জানি, আমি হত্যা মামলার আসামি। তাই এখানে আনা হয়েছে। কেন দুই সন্তানকে হত্যা করেছেন জানতে চাইলে জেসমিন বলেন, তাদের লেখাপড়া, ভবিষ্যৎ নিয়ে টেনশন ছিলো। বিচারক তখন জানতে চান, বাচ্চারা কোথায়, কোন ক্লাসে পড়তো। জেসমিন জানান, মেয়েটা ভিকারুন নিসা নূন স্কুলে এবার পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। আর ছেলেটা বনশ্রীর হলি ক্রিসেন্ট স্কুলে নার্সারিতে পড়তো।

তার স্বামী কি করেন বিচারক জানতে চাইলে তিনি জানান, ব্যবসা করেন। একইভাবে বিচারকের প্রশ্নের জবাবে জেসমিন স্বাভাবিকভাবে জানান, তার মা আছেন, বাবা নেই। গ্রামের বাড়ি জামালপুরে। একপর্যায়ে বিচারক জানতে চান, গত পাঁচ দিনের রিমান্ডে তাকে টর্চার বা কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে কিনা? জেসমিন তখন বলেন, কারও সঙ্গে আমার কোনো অবৈধ সম্পর্ক আছে কি-না এ বিষয়ে জানার জন্য আমাকে বারবার চাপ দেয়া হয়েছে।

আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আসামি পক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বিচারক বলেন, আপনারা বলছেন তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে তিনি সুস্থ। তিনি সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে বলতে পারছেন। এসময় তিনি জেসমিনের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মহিলা পুলিশের উপস্থিতিতে সতর্কতার সঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার নিদের্শ দেন বিচারক। পরবর্তীতে তাকে ডিবির হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়।

এর আগে গত ৪ঠা মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক স্নিগ্ধা রাণী চক্রবর্তী তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন। প্রথম দফা রিমান্ডে তাকে রামপুরা থানা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলেও মামলাটি ডিবিতে স্থানান্তর করায় জেসমিনকে শুনানি শেষে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেয়া হয়।

এদিকে গতকাল আদালতে বাদী ও আসামির কোনো স্বজনকে দেখা যায়নি। তবে আদালতে নেয়া এবং শুনানির সময় কৌতূহলী মানুষের ভিড় দেখা গেছে। রিমান্ড আবেদন শুনানিকালে মামলার বাদী আদালতে উপস্থিত কি-না বিচারক জানতে চাইলে বাদীর আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান তালকুদার জানান, তিনি অসুস্থ। এজন্য বিশ্রামে রয়েছেন। পরবর্তীকালে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি মানবজমিনকে জানান, বাদীর সঙ্গে তেমন যোগাযোগ হচ্ছে না। দুদিন আগে একবার ফোনে কথা হয়েছে।

অন্যদিকে, আসামি জেসমিনের আইনজীবী সাফায়েত আলী জানান, মামলার খোঁজখবর নেন জেসমিনের ভাই জাকির হোসেন সরকার। তার মাধ্যমেই এই মামলার আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি।

এদিকে নতুন করে তদন্ত তদারকের দায়িত্ব পাওয়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইকবাল হোছাইন জানান, পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। এই পাঁচ দিনে আমরা জানার চেষ্টা করবো ওই নারী ঠিক কী কারণে তার দুই সন্তানকে হত্যা করেছেন। আর এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে অন্য কারো ইন্ধন ছিল কি না তাও জানার চেষ্টা করা হবে।

উল্লেখ্য, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে রামপুরার বনশ্রীর বি ব্লকের চার নম্বর সড়কের নয় নম্বর বাড়ির পঞ্চমতলায় ভাড়া থাকতেন ব্যবসায়ী আমানউল্লাহ আমান। গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি ওই বাসায় হত্যা করা হয় তাদের সন্তান অরণী ও আলভীকে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রথমে রেস্টুরেন্টের খাবারের বিষক্রিয়ার কারণের কথা বলা হয়। তবে ময়নাতদন্ত শেষে ১লা মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস জানান, তাদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।

পরদিন জামালপুর থেকে দুই শিশুর পিতা আমানুল্লাহ, মা জেসমিন ও খালা আফরোজা মিলাকে আটক করে র‌্যাব। ৩রা মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাব জানায়, জেসমনি নিজেই তার দুই সন্তানকে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেছে। এই স্বীকারোক্তি শুরু থেকেই অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়। এ ঘটনায় জেসমিনকে আসামি করে মামলা করেছেন আমানউল্লাহ আমান।

সুত্র: মানবজমিন



মন্তব্য চালু নেই