ফের ভয়াবহ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে আরব বিশ্ব, জন্ম নেবে শত শত লাদেন!

ফের ভয়াবহ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে আরব বিশ্ব। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ আরেক যুদ্ধের ঘণ্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এনিয়ে বার্তা সংস্থা এপি একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। তাতে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

তখন কুয়েতে অনুপ্রবেশকারী ইরাকি বাহিনীর দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে মার্কিন বাহিনী মাত্র ১০০ ঘণ্টার জন্য স্থল অভিযান চালিয়েছিল কিন্তু সেই অভিযানের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক দশক ব্যাপী বিদ্যমান।

ওই যুদ্ধের পর পারস্য উপসাগর ও সৌদি আরবে সামরিক ঘাঁটি গেড়ে বসে আমেরিকা। আমেরিকার এই সিদ্ধান্ত ক্ষুদ্ধ ও রাগান্বিত করে তুলেছিল এক আরব তরুণ জঙ্গি ওসামা বিন লাদেনকে। ফলাফল, আল কায়েদার জন্ম এবং ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্বকে স্থম্ভিত করে দেয়া ভয়াবহ টুইন টাওয়ার হামলা।

উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রধান খেলোয়াড় তৎকালীন ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে কুখ্যাত হিটলারের চেয়েও জঘন্য বলে আখ্যা দিয়েছিলেন সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ সিনিয়র। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর সিনিয়র বুশের প্রেসিডেন্সির মেয়াদ শেষ হলেও সাদ্দাম তখনো ইরাকের সর্বেসর্বা। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধে সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত ও পরে হত্যা করেন সিনিয়র বুশের পুত্র জর্জ বুশ।

উপসাগরীয় যুদ্ধের ২৫ বছর পরে এখনো মার্কিন বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। আল কায়েদা থেকে জন্ম নেয়া জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন সেনাদের যেভাবে নাকাল করছে তা ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়।

১৯৯১ সালের ওই যুদ্ধের মার্কিন আরব মিত্ররা এখনো ঘরে-বাহিরে যুদ্ধ করছে এবং আন্তর্জাতিক অবরোধ প্রত্যাহার হওয়ার পরে মধ্যপ্রাচ্যের পরাশক্তি হওয়ার চেষ্টা করছে ইরান।

উপসাগরীয় যুদ্ধের পরাজিত শক্তি ইরাক নিজেও বর্তমানে খন্ডিত ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত। ইরাকের সুন্নি অধ্যুষিত বহু অংশে আইএস তাদের শাসন কায়েম করেছে, উত্তরে কুর্দিরা তাদের পৃথক স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল গঠন করেছে এবং ইরানের সহায়তায় শিয়ারা বাগদাদ নিয়ন্ত্রিত সরকার পরিচালনা করছে।

সব মিলিয়ে, ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যে সংকট এড়াতে চেয়েছিল বর্তমানে তারা সেই সংকটের মধ্যেই আটকা পড়েছে।

প্রতিবেশী কুয়েত ও আরব আমিরাত তেল উৎপাদনকারী সংস্থা ওপেকের কোটা পদ্ধতি ভঙ্গ করায় ইরাকের ১৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। কুয়েতের বিরুদ্ধে বিবদমান গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২.৪ বিলিয়ন ডলারের অপরিশোধিত তেলও চুরির অভিযোগ করেন সাদ্দাম। এই অজুহাতে ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট কুয়েতে আক্রমণ করে বসেন সাদ্দাম হোসেন।

কুয়েতের পরে সৌদি আরবেও আক্রমণ হতে পারে আশংকায় মার্কিন কর্তৃপক্ষ ওই অঞ্চলে তড়িঘড়ি করে সেনা মোতায়েন করে। মাসব্যাপী আলোচনা ও হুমকি-ধমকির পর ১৯৯১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কুয়েতে ইরাকি বাহিনীর উপর প্রথম হামলা চালায় আমেরিকা।

সামরিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে আসে। ৫,০০,০০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হলেও যুদ্ধে মাত্র ১৪৮ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং ৪৬৭ জন আহত হয়। এছাড়া উপসাগরীয় যুদ্ধের ফলাফল শীতল যুদ্ধ ও সোভিয়েত পরবর্তী যুগে আমেরিকাকে একক পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি প্রদান করে।

যুদ্ধের মোট ব্যয় ৬১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্র সৌদি ও কুয়েত ১৬ বিলিয়ন ডলার, আরব আমিরাত ৪ বিলিয়ন, জাপান ও জার্মানি একত্রে ১৬ বিলিয়ন ও দক্ষিণ কোরিয়া ২৫১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। বাকিটা যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো বৃহত্তর লাভের আশায় বহন করে।

উপসাগরীয় যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ কুশীলবদের অনেকেই আজ পৃথিবীতে নেই। তৎকালীন সৌদি বাদশাহ ফাহাদ ২০০৫ সালে মারা যান। ২০১১ সালের আরব বসন্তে ক্ষমতাচ্যুত হন মিশরের হোসনি মোবারক। দীর্ঘদিনের মার্কিন শত্রু সিরিয়ার স্বৈরশাসক হাফিজ আসাদ ২০০০ সালে নিহত হন। তার পুত্র বাশার আল আসাদ ক্ষমতা ধরে রাখার লক্ষ্যে এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সে অপচেষ্টা সিরিয়ায় বয়ে এনেছে ৫ বছর ব্যাপী গৃহযুদ্ধ এবং প্রাণহানী ঘটিয়েছে ২৫০,০০০ মানুষের। এছাড়াও কয়েক লক্ষ মানুষকে বানিয়েছে গৃহহীন শরণার্থী।

উপসাগরীয় যুদ্ধে ইসরাইলে আঘাত হানা ইরাকি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিস্টেম নির্মাণে বাধ্য করে। মার্কিন সহায়তায় ইসরাইলি প্রতিরক্ষা ব্যয় প্রত্যেক বছর ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

কুয়েতে ইরাকি বাহিনীর পরাজয় নিজ দেশেও সাদ্দামকে বিপদে ফেলে দেয়। শিয়া ও কুর্দিদের আন্দোলন কোনোরকমে দমন করে সে যাত্রা ক্ষমতায় টিকে যান সাদ্দাম হোসেন। শিয়া ও কুর্দিদের রক্ষায় ইরাকের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে নো ফ্লাইং জোন ঘোষণা করে আমেরিকা। এতকিছুর পরেও উপসাগরীয় যুদ্ধ পরবর্তী এক দশক সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যের ভয়ের প্রধান কারণ ছিলেন এই সাদ্দামই।

সেই ভয়কে বহন করতে না পেরে পরমাণু অস্ত্র খুঁজে পাওয়ার মিথ্যা অজুহাতে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। এরপর আফগানিস্তানেও হামলা চালানো হয়। তাদের ধারণা ছিল, ইরাকে আল কায়েদার উত্থান হলে ইরাকে মোতায়েন মার্কিন বাহিনী সুন্নি উপজাতিদের সহায়তায় তাদের ধ্বংস করতে পারবে। কিন্তু যখন ইরাক থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার করা হল এবং সুন্নি উপজাতিদের বাগদাদ সরকার সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দিল তখনই আল-কায়েদার ভষ্ম থেকে জন্ম নিল জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস। ২০১৪ সালে জন্ম নেয়া আইএস ইতিমধ্যেই ইরাক ও সিরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে।

আজ, যুক্তরাষ্ট্র একটি মারাত্মক গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়েছে। তেলের কারণেই সাদ্দাম কুয়েতে আক্রমণ করেছিল। সেই তেলের মূল্য মাত্র এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলার থেকে কমে ৩০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

অংশ বিশেষে এর কারণ একই। ওপেকের বাড়তি তেল উৎপাদনের সূত্র ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন পুরো অঞ্চলে যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছিলেন। আবার এই একই কারণে নতুন এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তপ্ত ভূমি মধ্যপ্রাচ্য।



মন্তব্য চালু নেই